মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হেজিমনির এই সংস্কৃতিকে প্রশ্ন করা দরকার

অর্ক ভাদুড়ি

 


লেখক সাংবাদিক, বাম রাজনীতিতে উৎসাহী

 

 

 

মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকল্প বলতেই মনে আসে ঢাকায় গণহত্যা আর গ্রেফতারের কথা শোনা মাত্র বয়োবৃদ্ধ মাওলানা ভাসানীর পায়ে হেঁটে আসামের উদ্দেশ্যে যাত্রা, যেন তিনি পাকিস্তানিদের হাতে ধরা না পড়েন। যেন মানুষের মনোবল ভেঙে না যায়। তাঁর বয়স তখন সত্তর কিংবা আশি— ঠিকঠিকানা নেই।

এই দৃশ্যটা এঁকেছিলেন সৈয়দ ইরফানুল বারী, তাঁর যাত্রাসঙ্গী: ক্রুদ্ধ পাকিস্তানী সেনারা সন্তোষে মাওলানার কুড়েঘরটা ছাই করে দিয়ে তাঁকে খুঁজতে নেমেছে গ্রেফতার করার জন্য। পথে পথে দগ্ধ গ্রাম, পলায়নপর অসংখ্য মানুষ। একবার দুবার মাওলানার দেখাও পেল হানাদাররা, কিন্তু অতিচেনা মুখটাকে আলাদা করতে পারল না আরও বহু গ্রামীণ বৃদ্ধের চেহারার সঙ্গে, সেই তালপাতার টুপি, সে ঢোলা পাঞ্জাবী তো আরও বহু মানুষেরই পরিধান। কেউই চিনিয়েও দিল না, ধরিয়ে দিল না তাঁকে। পাকিস্তানীরা খুঁজছে মাওলানা কোথায়, আর জনতার মাঝে মিশে পায়ে হেঁটে মাওলানা চলেছেন আসামের পানে।

পথে এক দরিদ্র চাষী অনুনয় করলেন তার বাড়িতে একবেলা দাওয়াত নিতে। সামান্য ভাত আর সালুন তিনি আয়োজন করতে পেরেছেন, তাই তৃপ্তির সঙ্গে খেতে খেতে তিনি সঙ্গী ইরফানুল বারীকে বলছেন: সৈয়দের বেটা, ভাত কম চিবায়ে খাও। পেটে বেশিক্ষণ থাকবে।

এই হল মুক্তিযুদ্ধের গল্প, আর উত্তর দিগন্তে যমুনা নদী ধরে মিলিয়ে যেতে থাকা মাওলানা ভাসানী মুক্তিযুদ্ধের চিত্রপট। মাওলানাকে বিদায় দিয়েছেন, সঙ্গী হতে পারেননি সৈয়দ ইরফানুল বারী, ভারতে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা ছিল, যেমন যেতে পারেননি হায়দার আনোয়ার খান জুনোরা। নরসিংদীতে তারা পুরোটা সময় জুড়ে এক অকুতোভয় প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়েছিলেন, কোনো স্বীকৃতির পরোয়া না করে। ভারতে যাবার আগে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তাদেরকেই ব্যবহারের জন্য দিয়ে গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত গাড়িটি। ভারতে পুরোটা সময়ই ব্যাপক প্রতিকূলতার মাঝে কাটিয়েছিলেন জহির রায়হান, তার অমর কীর্তি স্টপ জেনোসাইড যে বিরূপতার মুখে পড়েছিল খোদ কোলকাতায়, তার বিবরণ মিলবে মুশতারী শফির স্মৃতিকথায়। জুনোরাদের সঙ্গে আর যারা প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে গিয়েছিল, তাদের কেউ কেউ খুন হয়েছেন কিংবা আটক হয়েছেন। দেশের বহু অঞ্চলে এরাই গঠন করেছিলেন মুক্তাঞ্চল, পাকিস্তানী বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নিয়েই। এই হল মুক্তিযুদ্ধ নামের আখ্যানটির জটিলতা। কোনো উপন্যাসে আছে এই সংঘাতের ছাপ? জহির রায়হানকে নিয়ে কত কত লেখা, প্রায় সকলেই এড়িয়ে যান তার মতাদর্শিক পরিচয়। মওলানা ভাসানীও যে পুরোটা সময় ভারতে অন্তরীণ ছিলেন, সেই জটিলতাকে ধারণ না করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখা অসম্ভব।

উপরের লাইনগুলো লিখেছেন ফিরোজ আহমেদ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল গণসংহতি আন্দোলনের সংগঠক ফিরোজভাইয়ের এত বড় একটা উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা শুরু করলাম, কারণ যমুনা নদীর পাশ দিয়ে উত্তর দিকে হাঁটতে হাঁটতে অতিবৃদ্ধ মওলানা ভাসানী যখন দিগন্তে মিলিয়ে যান, তখন তাঁর সেই হেঁটে চলাই আমার কাছে আস্ত একটা বাংলাদেশ হয়ে ওঠে। পিছনে তাঁর বাড়ি পুড়ছে, দাউদাউ আগুন পিছনে ফেলে ভাসানী হাঁটছেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের দিকে হাঁটছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুক্তিযুদ্ধ চর্চায় এই হাঁটার কথা তেমন চোখে পড়ে না। চোখে পড়ে না পেয়ারাবাগানে সিরাজ শিকদারদের অলৌকিক প্রতিরোধের কথা। অথবা শিবপুরে মান্নান ভুঁইয়াদের আশ্চর্য মুক্তাঞ্চল নিয়ে আলোচনা। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী অকল্পনীয় বীরত্ব, মেনন-রনোদের গোটা দেশে ১৪টা মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলা, অথবা মণি সিংদের কমিউনিস্ট পার্টির অক্লান্ত পরিশ্রমের অর্জন আর্ন্তজাতিক সমর্থন— কোনও কিছু নিয়েই তেমন চর্চা দেখি না এই বাংলায়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চর্চায় কেবল একটি দল এবং একজন নেতার ছায়া। এতে আর যাই হোক, ইতিহাসের প্রতি সৎ থাকা যায় না।

***

 

একটা প্রবন্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকার কথা লেখা কার্যত অসম্ভব। আমার সেই যোগ্যতাও নেই। আমি কেবল চেষ্টা করব, খুব সংক্ষেপে, ফাঁকিবাজি করে, বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধে কী ভূমিকা পালন করেছিল, তার উল্লেখ করতে। বিশদ আলোচনার পরিসর এখানে নেই। কারণ, কেবল শিবপুর বা পেয়ারাবাগান নিয়েই এক একটা আস্ত বই লেখা যেতে পারে।

প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে প্রধান কমিউনিস্ট শক্তি হিসাবে কারা সক্রিয় ছিল। আর তারও আগে খুব সংক্ষেপে একবার ১৯৪৭/৪৮ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক।

১৯৪৮ সালে মওলানা ভাসানীই প্রথম পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে প্রদেশের জন্য অধিকতর ক্ষমতার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বললেন, “ব্রিটিশের শাসন মানি নাই। এবারও কেন্দ্রের হুকুমদারী মানব না।” ১৯৪৯ সালে ভাসানীর নেতৃত্বে যে আওয়ামি লিগ গঠিত হয়, তার কর্মসূচির মধ্যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন গুরুত্ব সহকারে জায়গা করে নিয়েছিল। শেখ মুজিব এবং খন্দকার মুশকাত ছিলেন সেই দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। মনে রাখতে হবে, সোহরাওয়ার্দি তখনও আওয়ামি লিগে যোগ দেননি। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ‘জিন্নাহ আওয়ামি লিগ’ গঠন করে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দি মাত্র ১৩ জন সাংসদ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ইস্কান্দার মির্জার আর্শীবাদপুষ্ট হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সিয়াটো-সেন্টো সমর্থন করলেন। সোহরাওয়ার্দির অবস্থানের পাশে থাকলেন শেখ মুজিব৷ ১৯৫৬-৫৭ সালের এই পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্রনীতি ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দির বিরোধ বাঁধে এবং ভাসানী আওয়ামি লিগ ত্যাগ করে নতুন দল ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি বা ন্যাপ গঠন করেন। সেই সময়ই ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনে ভাসানীই প্রথম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতার কথা ঘোষণা করেন। অবশ্য এর পরে তিনি আর এই দাবি নিয়ে অগ্রসর হননি৷ পরে, ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর তিনি আবার স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি উত্থাপন করেন।

১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারতের কাছে পাকিস্তানের লজ্জাজনক পরাজয়ের পর পাক বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে। আইয়ুবের মসনদ তখন টলমল করছে। সেই সময় শেখ মুজিব লাহোরে আইয়ুব বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সম্মেলনে যোগ দেন। সম্মেলনের শেষ দিনে সম্মেলন ত্যাগ করে মুজিব ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এই ৬ দফা বাঙালি জাতির একটা বড় অংশের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটিয়েছিল এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এর পাল্টা ভাসানীর ন্যাপ ১৪ দফা ঘোষণা করে। কিন্তু তা জনপ্রিয়তা পায়নি।

এ বার আসা যাক কমিউনিস্টদের কথায়।

১৯৬৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়। রুশপন্থী বলে পরিচিত মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি এবং চিনপন্থী বলে পরিচিত সুখেন্দু দস্তিদারদের পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী) বা ইপিসিপি (এমএল)। বিভক্তির আগে প্রায় দুই দশকে অবিভক্ত পার্টি একের পর এক গণসংগ্রামে অংশ নিয়েছে। নিষিদ্ধ অবস্থায় আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করেছে। ভাসানীর ন্যাপের মধ্যে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করেছে। কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের আগে-পরে অবিভক্ত ন্যাপ এবং ছাত্র ইউনিয়নও দুই টুকরো হয়ে যায়। চিনপন্থী ন্যাপ পরিচিত হয় ন্যাপ (ভাসানী) নামে৷ মস্কোপন্থী ন্যাপ পরিচিত হয় তাদের নেতা মোজাফফর আহমেদের নামে ন্যাপ (মোজাফফর) হিসাবে। সুবিশাল ছাত্র ইউনিয়নের চিনপন্থী অংশ রাশেদ খান মেননের মেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এবং মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে রুশপন্থী অংশ ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া গ্রুপ) নামে পরিচিত হয়। দুই কমিউনিস্ট পার্টিই যেহেতু বেআইনি ছিল, তাই তারা দুই ন্যাপের ভিতরে কাজ করতে থাকে।

মণি সিং

এরপর, ১৯৬৮-৭০ সালের মধ্যে ইপিসিপি (এমএল) কয়েক টুকরো হয়ে যায়-

১) পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)। নেতৃত্বে সুখেন্দু দস্তিদার, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল হক।
২) পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি। নেতৃত্বে দেবেন শিকদার, আব্দুল বাশার, আব্দুল মতিন (ভাষা মতিন)  ও আলাউদ্দীন আহমেদ।
৩) কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি। নেতৃত্বে কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনো।
৪) তখনও তেমন শক্তিশালী নয়, কিন্তু পরবর্তীকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা— পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন। যারা পরে সর্বহারা পার্টি নামে পরিচিত হয়। নেতৃত্বে সিরাজ শিকদার।
আমরা এই চারটি মূল ধারার মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা এক এক করে দেখে নেব।

 

পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির (মস্কোপন্থী) ভূমিকা

এই দলটি এখন সিপিবি বা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে, অর্থাৎ অবিভক্ত দলের বিভাজনের পর এই দলটি মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচিত ছিল।

কমিউনিস্ট গেরিলারা। একদম ডানে কমউনিস্ট পার্টি অফ বাংলাদেশের বর্তমান সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব পাকিস্তানের জনতার ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থান এবং বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্খার সুস্পষ্ট প্রকাশ হিসাবে ব্যাখ্যা করে। কমিউনিস্ট পার্টি বলে, নির্বাচনের ফলাফলকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণি কোনওভাবেই মেনে নেবে না। এই অবস্থায় গোটা দেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে হবে৷ পার্টির এই বিশ্লেষণ সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়। ১ মার্চ, ১৯৭১ ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, জাতীয় সংসদের অধিবেশন হবে না। এর প্রতিবাদে সর্বত্র জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়েন। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা অন্য বিরোধী দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন, আসন্ন যুদ্ধের জন্য জনতাকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করেন।

৭ মার্চ শেখ মুজিব রেসকোর্সের জনসভায় ঘোষণা করেন, ‘এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। কমিউনিস্ট পার্টি এই বক্তব্যকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানায়। ৯ মার্চ কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতিটি শাখায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে সার্কুলার পাঠায়। ঢাকা সহ সর্বত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা হয়। তাদের কুচকাওয়াজ ও ট্রেনিং শুরু হয়। ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে তরুণ তরুণীদের রাইফেল ট্রেনিং দেওয়া হয়। ডেমরা এলাকায় শ্রমিকদের সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়।

২৫ মার্চ পাকবাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা সর্বত্র আওয়ামি লিগ, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সঙ্গে মিলে এবং এককভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এপ্রিলের মাঝামাঝি এই প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে বড় অংশের পার্টিকর্মী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং নেন। এই সময়ই মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই-এর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর্ন্তজাতিক জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়।

এপ্রিল মাসেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে পার্টি তাকে সমর্থন জানায়৷ দেশের মধ্যেই বিভিন্ন এলাকায় পার্টি কর্মীরা ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলেন। আব্দুস সালাম, খোকা রায়, মহম্মদ ফরহাদ, জ্ঞান চক্রবর্তীর মতো নেতারা ঢাকা জেলার বেলারো থানার রায়পুরায় ঘাঁটি করে অবস্থান করতে থাকেন। রায়ওউরার প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে তাঁরা ভৈরবের দিকে আশুগঞ্জে চলে যান। এরপর এক পর্যায়ে তাঁদের একাংশ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন।

মণি সিং বলছেন, পার্টিকর্মী এবং তাঁদের পরিবার মিলিয়ে পার্টি পেরিফেরির প্রায় ৬ হাজার মানুষ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে অবস্থান করতে থাকেন। এই পর্যায়ে পার্টিকর্মীদের কাজের ধারা ছিল এইরকম:

১) কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ক্যাম্প স্থাপন
২) মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিংয়ে ক্যাডারদের পাঠানো
৩) ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কনিউনিস্ট পার্টির মিলিত গেরিলা বাহিনী গঠন
৪) প্রথমে আগরতলা ও পরে কলকাতায় কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যালয় তৈরি করে কাজ করা
৫) নিজস্ব গেরিলা বাহিনীকে দেশের ভিতরে যুদ্ধ করতে পাঠানো
৬) মুক্তিযুদ্ধ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ।

এই সময় কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন মোট ১৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের ভিতরে লড়াই করতে পাঠায়। তাঁরা আশ্চর্য বীরত্বের প্রমাণ রাখেন। এখানে তার বিশদ বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। ঢাকা, নরসিংদী রায়পুর, কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, রংপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, অসংখ্য কর্মী শহীদ হয়েছেন। চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ ডুবিয়ে দেয় তাঁরা। কুমিল্লার বেতিয়ারায় ঐতিহাসিক প্রতিরোধ সংগ্রামে আজাদ মুনির সহ নয়জন শহীদ হন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শহীদুল্লাহ্ কায়সারকে খুন করে আল বদর বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকারের যে পরামর্শদাতা কমিটি গঠিত হয়, মণি সিং তার সদস্য হন। তার আগে এবং পরে আর্ন্তজাতিক সমর্থন লাভে কমিউনিস্ট পার্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এপ্রিল মাসে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রমেশ চন্দ্র দাসের সহযোগিতায় তিন সদস্যের একটি দল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সফর করে পাকবাহিনীর নৃশংসতার কথা তুলে ধরেন৷ কোচিনে সিপিআই-এর পার্টি কংগ্রেসে বিশ্বের ২২টি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে মুক্তিযুদ্ধের কথা বিশদে জানানো হয়। এই বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর্ন্তজাতিক সমর্থন পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল।

রাজপথে ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা

 

চিনপন্থী কমিউনিস্টদের ভূমিকা

আগেই লিখেছি ১৯৬৮-৭০ সালের মধ্যে চিনপন্থী বলে পরিচিত দলগুলি কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়েছে যায়। আমরা একে একে খুব সংক্ষেপে তাদের ভূমিকা দেখে নেব।

সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি প্রথম থেকেই পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই তারা বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সামরিক পদক্ষেপ করে। যুদ্ধ শুরুর আগেই তারা পাকিস্তান কাউন্সিলে বোমা ছোড়ে। অনেকটা ভগৎ সিংদের মতেই। এই ঘটনা তীব্র আলোড়ন তৈরি করেছিল।

সুখেন্দু দস্তিদারের দল ইপিসিপি-এমএল দ্বিধাবিভক্ত হয়। একদিকে সুখেন্দু দস্তিদার ও তোয়াহা, অন্যদিকে আব্দুল হক। সার্বিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে এই অংশের ভূমিকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তোলার হয়তো অবকাশ আছে। এঁরা গ্রামাঞ্চলে কৃষি বিপ্লব গড়ে তোলার লাইন নেন। তবুও তাঁদের অনেকেই পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছেন৷ তোয়াহার নেতৃত্বে নোয়াখালিতে, মন্টু মাস্টার ও এবাদ আলির নেতৃত্বে রাজশাহীর তানোরে, সালাউদ্দিন, হাজি বশীর, কাপ্তেন জাহেদদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে, খন্দকার আলি আব্বাসের নেতৃত্বে নবাবপুর থানা ও মানিকগঞ্জে গড়ে ওঠে অসামান্য গণসংগ্রাম। এখনও ওই সব এলাকায় কিংবদন্তির মতো মুখে মুখে ঘোরে প্রতিরোধের কাহিনী৷ বিশদে যাব না, তবুও নোয়াখালির কথা একটু বলি। এখানে কমিউনিস্টরা ২০০০ একর জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করেন৷ ১৯৭৪ সাল অবধি এই জমি কৃষকদের অধিকারে ছিল। পরে শাসকদল আওয়ামি লিগের রক্ষী বাহিনীর অত্যাচারে অধিকাংশ জমি বেদখল হয়। তোয়াহার নেতৃত্বে ওই এলাকায় এক ধরনের নিজস্ব প্রশাসন ও প্রকাশ্য গণ আদলত গড়ে ওঠে।

আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্টরা মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর অবস্থান নিয়েছিল। তা সত্ত্বেও বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও কুষ্টিয়া জেলায় তারা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলে।

১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিও দ্বিধাবিভক্ত হয়। দেবেন শিকদার ও আবুল বাশারের নেতৃত্বাধীন অংশটি জাতীয় সংগ্রামের মূল স্রোতের সঙ্গে থাকলেও অন্য অংশটির ভূমিকা একটু অন্যরকম ছিল বলে মনে করছেন হায়দার আকবর খান রনো। তবুও এই অংশটিও অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টিপু বিশ্বাসের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বাহিনী পাবনা শহরকে স্বাধীন করে লাল পতাকা উড়িয়ে দেয়। টিপু বিশ্বাস লোকমুখে মেজর টিপু নামে পরিচিত হয়ে যান।

কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ১৪টি ঘাঁটি এলাকা বা কার্যত মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলে। নরসিংদীর শিবপুর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় কার্যত নতুন ইতিহাস তৈরি করেন তাঁরা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে উপরে যে জায়গাগুলি স্থান পেতে পারে তার অন্যতম  শিবপুর।

শিবপুরের নেতা ছিলেন মান্নান ভুঁইয়া৷ এই মুক্তাঞ্চলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। এখানকার কোনও অস্ত্র ভারত থেকে আসেনি। কমিউনিস্টরা পাকবাহিনীর থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিলেন এবং ইপিআর ও সেনার পরিত্যক্ত অস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন৷ অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, শিবপুরে প্রায় কোনও রাজাকার তৈরি হয়নি। কয়েকজন ডাকাত ছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা কাউকে হত্যাও করেননি। শিবপুরে এক ধরনের জনপ্রিয় গণপ্রশাসন তৈরি হয়, যা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিরল।

শিবপুর নিয়ে পরে কখনও বিশদে লেখা যাবে। খুব সংক্ষেপে কয়েকটা লাইন লিখে যাই। শিবপুরের কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সঙ্গে অসংখ্য যুদ্ধ করেছিলেন। কয়েকবার পাকবাহিনী মান্নান ভুঁইয়ার বাড়িতে আগুন দিতে এসে বাড়ি খুঁজে পায়নি। একটি লোকও বাড়ি চিনিয়ে দেয়নি। মরে গেছে মার খেয়ে, গুলি খেয়ে, তাও বাড়ি চিনিয়ে দেয়নি। শিবপুরে যুদ্ধ চলাকালে কোনও ডাকাতি হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা জনতার সঙ্গেই থাকতেন, মাছের মধ্যে জলের মতো।

শিবপুরের বাইরেও মনোহরদি, রায়পুরা, নরসিংদী পর্যন্ত কমিউনিস্টদের প্রভাব বজায় ছিল। শিবপুরের গ্রামাঞ্চক মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের প্রায় পুরো সময়টাই মুক্ত ছিল।

সাতক্ষীরাতেও কমিউনিস্টরা বিরাট বাহিনী গড়ে তোলেন। ১৮ বছরের তরুণ কামেল বখত নেতৃত্ব দেন মুক্তিবাহিনীকে। কামেল বখত বন্ধকী জমি উদ্ধারের কাজ শুরু করেন। যা বিরাট সংখ্যায় কৃষকদের আকৃষ্ট করে। পরে আওয়ামি লিগাররা কামেলকে খুন করে।

দেবেন শিকদার, আবুল বাশারদের ‘বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ নোয়াখালি, চট্টগ্রামে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছিল। চাঁদপুরে এই দলের নেতা বিএম কলিমুল্লার গড়ে তুলেছিলেন বিরাট ঘাঁটি এলাকা।

১৯৭১ সালের ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের একটি সম্মেলন হয়। তাতে ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্ব নেন সিপিআইএম কর্মীরা। হায়দার আকবর খান রনো লিখছেন, কিন্তু সম্মেলনের রাজনৈতিক ব্যাপারে তাঁরা কোনও পরামর্শ দেননি। এই সময় কমিউনিস্টদের একাংশ ভাসানীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু দেখা হয়নি। মেনন, রনোদের দলের দাবি, ভাসানী গৃহবন্দি ছিলেন। এই সময় ভাসানীর একটি চিরকুট তাঁদের হাতে আসে। সেখানে তিনি লেখেন— “তোমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালাইয়া যাইবে। কোনও আপস ফর্মুলা মানিবে না।” হায়দার আকবার খান রনোর দাবি অনুযায়ী, ভারতে পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের গ্রেফতারি সম্ভাবনা ছিল। নৃপেন চক্রবর্তী সহ সিপিআইএম নেতারা সে বিষয়ে তাঁদের সাহায্য করেছিলেন।

কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ক্র্যাক প্লাটুনে৷ খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন এই বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন কমিউনিস্ট। তাঁদের অন্যতম শহীদ রুমি। মায়ের কলমে যাঁর স্মৃতিকথা অক্ষয় হয়ে আছে।

১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষে বরিশালের ৭২ মাইল ব্যপী বিশাল পেয়ারাবাগানে সিরাজ শিকদারের বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের এক গৌরবময় অধ্যায় রচনার কাজ শুরু করে। ঝালকাঠি থানার যাবতীয় অস্ত্র দখল করে এবং অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে পেয়ারাবাগানে মুক্তাঞ্চল গড়ে ওঠে। কয়েক হাজার মন চাল, ডাল, লবণ, গুড়, চিনি এবং কয়েকশো নৌকা পাঠানো হয় সেখানে। ২৫ এপ্রিল পাকবাহিনীর সর্বাত্মক হামলায় বরিশাল শহরের পতন ঘটে। দলে দলে মানুষ শহর ছেড়ে পেয়ারাবাগানের আশেপাশের গ্রামে আশ্রয় নেয়। সিরাজ শিকদারের কমরেডরা এই বিপুল জনতাকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করেন। ৩০ এপ্রিল বিপুল জনসমাবেশের মধ্যে দিয়ে গঠিত হয় পূর্ববাংলা জাতীয় মুক্তিবাহিনী। উদ্বোধনী বক্তৃতায় সিরাজ শিকদার প্রধান শত্রু পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর পাশাপাশি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা ঘোষণা করেন।

৭ মে গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে পাকবাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ওই দিন কীর্ত্তিপাশা নদী দিয়ে পাকবাহিনী পেয়ারাবাগানের গ্রামগুলিতে ঢুকে লুটপাট চালায়, অগ্নিসংযোগ করে। বিকেলে ৮টি গেরিলা সেক্টরের কমিউনিস্ট গেরিলারা একত্রিত হয়ে সিরাজ শিকদারের প্রত্যক্ষ নির্দেশে ২০ গজ দূর থেকে আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের ২৪ জনকে হত্যা করে ও প্রচুর অস্ত্র দখল করে।

সিরাজ শিকদার

এই শুরু৷ তারপর দফায় দফায় অসংখ্য সংঘর্ষে পাকবাহিনীকে পর্যদুস্ত করেন কমিউনিস্টরা। এই সময় পেয়ারাবাগানে প্রায় এক লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিলেন। পাকবাহিনী বিপুল সংখ্যক সেনা নিয়োগ করে পেয়ারাবাগানের মুক্তাঞ্চলকে ধ্বংস করতে। সেই ঘেরাও-এর মধ্যেই জুন মাসে জন্ম নেয় নতুন কমিউনিস্ট দল— সর্বহারা পার্টি। সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে চলতে থাকে পার্টি ক্লাস, তাত্ত্বিক চর্চা। এক পর্যায়ে পাক সেনাদের ঘেরাও ভেঙে সন্ধ্যা নদী পেরিয়ে প্রায় লক্ষাধিক পার্টিকর্মী, গেরিলা ও জনগণকে নিয়ে যেতে সমর্থ হন কমিউনিস্টরা। এই ঘটনাটিও বিশদে আলোচনার দাবি রাখে। এমন আশ্চর্য বীরত্ব উপমহাদেশের ইতিহাসে বিরল।

***

 

কমিউনিস্টরা মুক্তিযুদ্ধে কী ভূমিকা পালন করেছিলেন, সময়, নিষ্ঠা এবং চর্চার ঘাটতি থাকায় এই প্রবন্ধে তা সঠিকভাবে লিখতে পারলাম না। বিক্ষিপ্তভাবে যে টুকরো টুকরো তথ্যের উল্লেখ করলাম, তার বাইরেও আরও হাজার হাজার ঘটনা রয়েছে। সেগুলি প্রত্যেকটিই পৃথক ও বিশদ আলোচনার দাবি রাখে।

মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্টদের ইতিহাস আমরা এই বাংলায় তেমন জানি না। কেন জানি না? কারণ আমাদের মগজে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এক ধরনের হেজিমনির রাজত্ব। মুক্তিযুদ্ধকে একটি দল এবং একজন নেতার চোখ দিয়ে পড়ার এই কুচ্ছিত সংস্কৃতিকে অবিলম্বে প্রশ্ন করা দরকার।

মুক্তিযুদ্ধকে কমিউনিস্টদের অনেকেই কেবল জাতীয় স্বাধীনতার লড়াই হিসাবে দেখেননি। দেখেছিলেন শোষণমুক্তির আন্দোলনের সোপান হিসাবে। সেই স্বাধীন, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন সফল হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বৈরাচারী শাসন, যা এখনও চলছে। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের স্বঘোষিত ঠিকাদারদের সীমাহীন স্বৈরাচার, নৈশকালীন ভোটে জিতে সরকার গঠন। অন্যদিকে লুটপাট, দুর্নীতির ইতিহাসের সঙ্গে মৌলবাদের ককটেল। এই কুৎসিত দ্বিদলীয় বৃত্ত ভাঙাই এখন বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কঠিন। সময়সাপেক্ষ৷ কিন্তু অসম্ভব নয়। এই চ্যালেঞ্জ যদি বাংলাদেশ নিতে পারে, তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4651 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. অর্ক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তুমি যা বলেছ একশ ভাগ সত্য ।বেলেঘাটার শূড়াকণ্যা স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের যে গোপন সভা হয়েছিল সেই সভার স্বেচ্ছাসেবক আমি ছিলাম। C P M এর বেলেঘাটা লোকাল কমিটির দায়িত্বে এই সভা হয়েছিল। সভায় রন মেনন শিকদার আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন । সম্ভবত ভাসানির ছেলেও ছিলেন। সে এক অসাধারণ অনুভব। তোমার উল্লিখিত দলগুলি ছাড়াও আরো দল ছিল। যেমন মারুফ হোসেনের শ্রমিক কৃষক দল ইত্যাদি । মারুফ হোসেনের সাথে আমরা ঠিক যুদ্ধ শেষের পরই বাংলাদেশ গিয়েছিলাম । যশোর জেলায় ন্যাপের প্রভাব দেখেছিলাম । এদের সবার কাছ থেকে ভাসানি সম্মন্ধে শুনতাম। আশ্চর্য আশ্চর্য সব গল্প । একাধারে এক জন মানুষের মৌলানা হওয়া আরেকদিকে অসাম্প্রদায়িকতা দুটোই বর্তমান । ভাসানি যে স্বাধীনতার কথা প্রথম বলেছিলেন এটা অনিস্বীকার্য। বামপন্থীদের লড়াই বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। তবে পৃথিবীর ইতিহাস এভাবেই তো বারবার লেখা হয়েছে । যে শক্তি ক্ষমতা পেয়েছে তারা অন্যদের অবদান মুছে দিয়ে সমস্ত আলো নিজের মুখে ফেলে একমাত্র মুক্তিদাতা হিসাবে নিজেকে তুলে ধরেছে। এটা রাশিয়া চীন ভিয়েতনাম ভারতবর্ষ ইরান সর্বত্র একই ইতিহাস। এই সরকারি ইতিহাসকে প্রশ্ন করা, উত্তর খোঁজার মধ্যে রয়েছে আমাদের সমস্ত রকমের সমর্থন । ধন্যবাদ অর্ক।

  2. এই গানটা যত না ইন্টারেস্টিং, তার চেয়েও বেশি ইন্টারেস্টিং মঞ্চটা। বিশেষ করে মঞ্চের মানুষগুলোর মুখচোখ৷ সায়ানের ঠিক পিছনেই আনিসুজ্জামান, শ্রদ্ধেয় মানুষ, বিরাট বুদ্ধিজীবী, বিবেকবান ও সৎ। কিন্তু আওয়ামী লীগের দুর্নীতি, স্বৈরাচারের নীরব সমর্থক। কিছু বললেই “বিকল্প কী” প্রশ্ন করতেন। একদম ডানদিকে সম্ভবত শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী৷ সংগ্রামী জীবন। কিন্তু সেই একই আওয়ামী হেজিমনি। “বিকল্প দেখান। আওয়ামী লীগ খারাপ, কিন্তু কিছু বললেই বিএনপি-জামাত চলে আসবে”- এই যুক্তির লোক। এই ভদ্রলোকদের সামনে একটা মেয়ে ” স্বাধীনতার পক্ষশক্তি” বলে আওয়ামী লীগকে উলঙ্গ করে দিচ্ছে। আনিসুজ্জামান, কামাল লোহানীরা অস্বস্তিতে পড়ছেন। এই অস্বস্তি সুন্দর।

    https://youtu.be/ftBAuhxyjIo

    অর্ক, দেখো সময় করে। আনিস স্যার হাততালিও ঠিক করে দিতে পারলেন না।

  3. লেখকের লেখাতে মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের সব ভূমিকা ওঠে আসবে এটা আমি আশা করি না। কারণ এই পরিসরে সেটা সম্ভবও না। কিন্তু কিছু তথ্য তিনি দিয়েছেন যা বিভ্রান্তিমূলক। আমি সেই অংশটুকুর বিরোধীতা করছি।

    ‘এই সময় কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন মোট ১৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে দেশের ভিতরে লড়াই করতে পাঠায়। তাঁরা আশ্চর্য বীরত্বের প্রমাণ রাখেন। এখানে তার বিশদ বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। ঢাকা, নরসিংদী রায়পুর, কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, রংপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, অসংখ্য কর্মী শহীদ হয়েছেন। চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ ডুবিয়ে দেয় তাঁরা। কুমিল্লার বেতিয়ারায় ঐতিহাসিক প্রতিরোধ সংগ্রামে আজাদ মুনির সহ নয়জন শহীদ হন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শহীদুল্লাহ্ কায়সারকে খুন করে আল বদর বাহিনী।’
    যেসব স্থানের কথা তিনি বলেছেন সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নে কেউ কোনো লড়াই করেনি। বেতিয়ারে যে ঘটনার কথা বলেছেন সেটা ১১ নভেম্বরের কথা। দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর। মানে স্বাধীনতার ৩৫ দিন আগের ঘটনা। সেটাও যুদ্ধ না। ভারত প্রত্যাগত রুশপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) কর্মীরা ওখান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের মুখে পাকিস্তানী বাহিনীর মুখে পড়ে যায়। বলা যেতে পারে সিপিবির নেতাদের সাধারণ ধারণাও ছিল না কোথায় কি পজিশনে যুদ্ধ হচ্ছে-সে কারণে তারা তাদের কমরেডদেরকে আত্মহুতি দিতে সরাসরি পাকিস্তানী বাহিনীর মুখে ঠেলে দিয়েছে। আর কোনো যুদ্ধের ইতিহাস সিপিবির নেই।
    ঢানরসিংদী রায়পুর, কুমিল্লা, নোয়াখালিতে পিকিংপন্থিরা যুদ্ধ করেছেন যাদের আমরা নকশাল নামে চিনি। সিপিবির কোনো যুদ্ধের ইতিহাস আমাদের জানা নেই।
    লেখক এই ইতিহাস কোথায় পেয়েছেন জানার খুব আগ্রহী। যদি আপনি বলেন তাহলে উপকৃত হবো।

Leave a Reply to জনৈক শুভানুধ্যায়ী Cancel reply