প্রতিভা সরকার
বারোটা পঞ্চাশে হাওড়া-রাঁচি ইন্টারসিটি ছাড়বে, আর সাড়ে বারোটায় আমরা মানিকতলায় ওয়াইএমসিএ-র সামনে গাড়ির জানালা দিয়ে দেখছি কুকুর ডায়ালিসিস খ্যাত নতুন মন্ত্রীমশাই স্বামী বিবেকানন্দ সেরে লাল বাতি জ্বালানো গাড়িতে সবে উঠে বসলেন। রাস্তা জোড়া চেলাচামুণ্ডা।
এমনিতেই সারা রাস্তা ছোট বিবেকানন্দ, বড় বিবেকানন্দ, হলুদ কমলা শাড়ি পরা কিশোরী, তরুণী, মাথায় তাদের ফুল গোঁজা আর রাস্তায় যেন পেরেক ঠোঁকা, এমনি হোঁচট-জ্যাম।
আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি। পুরুলিয়া হ’ল না এই পঞ্চমবারে।
টুসু এবার আমায় ডাকেনি।
সেখান থেকে কী ক’রে বারোটা সাতান্নতে হাওড়াতে আঠারো নম্বর প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি ছুটে এলাম জানি না। ছেড়ে দিয়েও সিগন্যালে আটকে গাড়ি যেন আমার জন্যই পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে। ভাগ্যিস প্ল্যাটফর্ম ছাড়ায়নি। আমি দুদ্দাড় উঠতেই পায়ের তলায় টের পেলাম ইস্পাতের মেঝের নড়নচড়ন। মালপত্র বয়ে বেদম হয়ে পড়া সঙ্গীকে তাড়াতাড়ি নেমে যেতে বললাম।
নিজে সিটে বসে জিভ বার করে কুকুর-হাঁপান দিতে দিতেই ইনহেলারে টান দিলাম। শ্বাসকষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল।
তবু মনে হল, ভুল ভেবেছিলাম, টুসু আমায় ডেকেছে।
টুসু হামদের দুলালী বঠ্যে, টুসু হামদের সাধের ধন
টুসু আমার কেউ না। তবে গোটা মানভূমের সে অতি আদরের কন্যা, পূজ্যাও বটে। অঘ্রানের সংক্রান্তিতে তার পূজা শুরু হয় ঘরে ঘরে, শেষ হয় পৌষের শেষদিনে টুসুর প্রতীক একটি সজ্জিত চৌদলকে (চৌডল/চতুর্দোলা) নদীর জলে ভাসিয়ে। এটি টুসুকে শ্বশুরঘরে পাঠাবার প্রতীক। মানভূমের বেশিরভাগ জায়গাতেই টুসুর কোনও মূর্তি নেই। কোথাও পূজারিণীরা, যাদের টুসুনি বলে, ইচ্ছেমত ছোট মাটির মূর্তি বসিয়ে দেয়। বান্দা ব্লকে জৈন দেউলের পাশে বসে বর্ণালী বাউরি আমায় বলেছিল কেউ কেউ আবার লালকালো কুচফলের মতো তুচ্ছ জিনিস বন থেকে তুলে এনে সরায় রেখে সারা মাস পূজা করতে থাকে। বর্ণালীর চুল মাথার ওপর সাধনার মতো বুফে স্টাইলে বাঁধা, মাধ্যমিকে ব্যাক পেয়ে সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছে এবং সে টুসু রাখে না। কারণ জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারি কোনকালে তার বাবার এক সম্পর্কিত ভাই টুসুকালে মারা যাওয়ায় তাদের পরিবারে এ পূজা নিষিদ্ধ।
যা বলছিলাম, আসল হল গে ঐ মাটির সরা। নতুন মাটির সরা, তার ভেতরে নতুন ধানের তুষ এবং নতুন গোবৎসের গোবরের ডেলা। তাকে কুলুঙ্গিতে স্থাপন করে রোজ বনফুল তুলে এনে মেয়েরা একমাস টুসুপুজো করে ভক্তিভরে। এ পুজোর মন্ত্র শুধু গান। যে মেয়েরা টুসুপুজো করে তাদের বলে টুসুনি। টুসুনিরা গোল হয়ে বসে সন্ধ্যের প্রদীপ জ্বেলে স্বরচিত বা মা ঠাকুমার কাছে শেখা টুসুগীত গায়। তারপর চিঁড়ে মুড়ি, বাতাসা, মিষ্টি বিতরণ হলে যে যার কাজে লেগে পড়ে।
টুসুগান তাই ভারী মিঠে। একে তো শ্রমজীবী স্বল্পশিক্ষিত গ্রাম্য নারী বিরচিত এবং সুরারোপিত, প্রতিবেশের যাবতীয় সারল্য এতে বহমান, উপরন্তু এ তো প্রিয় আবাহনের মন্ত্রও বটে। দৈনন্দিন জীবনের আনন্দবেদনার মাঝখানে ঈশ্বরকে প্রিয়রূপে আবাহনের গান। ইদানীং পুরুষেরা গান বাঁধেন, সুর দেন বা গান করেন, কিন্তু তা একইরকম করুণ, বেশি ওঠাপড়া নেই, নেই কালোয়াতি প্যাঁচপয়জার। শুনতে শুনতে কেমন নেশা লেগে যায়। রিনরিনে কণ্ঠগুলোর গ্রাম্য সুরে কেমন জড়িয়ে যায় দূরের পাহাড়ের নীলচে রেখা, পাথরের ওপর কাঁসাইয়ের আঁকিবুঁকি, মার্চ মাসে আগুন লাল হয়ে যাবার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা অগুন্তি পলাশগাছ আর তাদের পায়ের তলায় মানুষ-সমান উঁচু সোনাগলা সর্ষেখেত। শুনতে শুনতে মনে হয় এই ঝিম ধরা সুর উঠে আসছে মানভূমের হৃদয়-কন্দর থেকে, হাজার হাজার বছর আগে অজস্র ড্যামের শৃঙ্খলমুক্ত কংসাবতী, শিলাবতীর ঢেউয়ের নুপুরনিক্কণ থেকে!
আর টুসুগানের বাণী বা কথা? সে আর এক আশ্চর্য জগত! কন্যাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবার বেদনা থেকে শুরু করে— ই দ্যাশে আর রইব না গ্য/ ভিন দ্যাশে চলে যাবো/ চল টুসু কইলকেতা যাই/ খাতা কলম কিনে লই… জাতীয় মাতৃহৃদয়ের সব সম্ভব অসম্ভব ইচ্ছার প্রকাশ ঘটায় তারা। টুসু কখনও কিশোরী, কখনও বিবাহযোগ্যা যুবতী। আবার কখনও নেহাতই শিশু। রাঁধতে শেখেনি সে এখনও, তাই মায়ের প্রাণ সবজির প্রাচুর্যেও ভয় পায়— আদাড়ে বাদাড়ে ঝিঙ্গা/ অ ঝিঙ্গা তুই ধরিস না।/ আমার টুসু শিশু ছেইলা/ ঝিঙ্গা রাঁধতে জানে না।
এমনও হয় যে টুসু গানে টুসুই অনুপস্থিত। আগেও তা হত, তবে তা চাটুকারিতা ছিল না সেসময়। কিন্তু শোনা গেল ইদানীং শিল্পীভাতা প্রাপ্ত সব টুসু ভাদু শিল্পীদের অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি সব প্রজেক্টের গুণগান। টুসুকে বাদ দিয়ে রূপশ্রী ভাতার কথা গান হয়ে কানে এলে সেটাকেও টুসুগান ধরে নিতে হবে এই তথ্য নিয়েই রওনা হলাম মহাদেববেড়্যার দিকে।
যেখানে মেলা বসেছে সেখান থেকে কাঁসাই নদীর দূরত্ব কম করেও দু কিলোমিটার। ভারী সুন্দর সরু পায়ে-চলা উঁচু নিচু পথ মাড়িয়ে রঙিন পোশাক পরা হাজার হাজার লোক চলেছে নদীর দিকে। চারপাশের ফসল কেটে নেওয়া মুক্ত মাঠের মধ্য দিয়ে আশপাশের গ্রাম থেকে ঠেলে আসছে মানুষের স্রোত। তাদের মাঝে মাঝেই মেয়েদের ছোট বড় দঙ্গল সেই বিচিত্র নেশা ধরানো সুরে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছে, হাতে ধরা নানা রঙের চৌডল। আর যাচ্ছে মোটর বাইক। অগুন্তি চাকা কাঁসাইয়ের শীর্ণ বুক চিরে এপার ওপার করছে, জল থেকে উঠে এসে অবলীলায় খাড়াই পাড়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। টুসুর সত্যি সত্যি বিয়ে হলে বোধহয় এখন পণ দিতে হত মোটর সাইকেল। এইই দস্তুর এখন সমস্ত গ্রামবাংলায়।
এই টুসু-টি কে বঠ্যে!
এই টুসু কিন্তু আসলে নবান্নের দেবী, কৃষির অধিষ্ঠাত্রী। গোলা ভরে ওঠার সূচনায় তার আবাহন। পুরো একমাস শস্য-উৎসবের শেষে গোলা ভরা ফসলের পরিপূর্ণতার কালেই টুসুর বিসর্জন তাকে ফিরিয়ে আনবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। এই যে টুসু উৎসব বা মকর পরব এটি প্রচলনের পেছনে ঐতিহাসিক কারণটিকে যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বা ডঃ সুকুমার সেনের মতো পণ্ডিতরা প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এখন আমরা ১লা বৈশাখে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে মাতি বটে, কিন্তু হাজার/দেড় হাজার বছর (“২৪১ শকে ইং ৩১৯ সালে”, বিদ্যানিধি) আগে জ্যোতির্বিজ্ঞানসম্মত গণনা পদ্ধতি পয়লা মাঘকে কৃষিবর্ষের প্রথম দিন ও পৌষ সংক্রান্তির দিনটিকে বছরের শেষ দিন বলে মান্যতা দিত। তখন চৈত্র-বৈশাখকে বসন্তকাল ও আশ্বিন-কার্তিককে শরৎ ঋতু বলে ধরা হত। তার থেকেও পিছিয়ে যাই যদি, তাহলে দেখা যাবে তখন বছরের শুরু হত অগ্রহায়ণ মাস থেকে। তাই এর নাম হয়েছিল মার্গশীর্ষ। ষোলোশো বছর আগে এই বাংলায় পৌষ সংক্রান্তির দিনটি বছরের শেষ দিন, সূর্যের উত্তরায়ণ আরম্ভের দিন। পরদিন ১লা মাঘ নতুন বছরের শুরু। সারা মানভূমে এখ্যান বা আখ্যান যাত্রার দিন। কৃষিজীবীর বহুদিন আগে হারিয়ে ফেলা নববর্ষ উদযাপনের স্মৃতি-উৎসব। নদীতে স্নান, নব বস্ত্র পরিধান, মেলা, ঝুমুর, নাচনি, ছৌ, আমোদিত পরিবেশ। এর সূচনা আগের দিন মেয়েদের টুসু পুজো দিয়ে। নদীতে চৌডল ভাসানো মানে বিসর্জনের শোক পালন নয়, বরং পুরনো নষ্ট শস্যের ভাসানের মাধ্যমে তার পুনর্জন্মকে ত্বরান্বিত করা। আদিম মানুষ অঙ্কুর থেকে বীজের উদ্গমকে অলৌকিক রহস্য বলে ভাবত আর বিশ্বাস করত মৃত্যু এবং পুনর্জাগরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে। টুসু শব্দটির উৎস যদি হয় ধানের তুষ, তাহলে মাটির সরায় গোবরের উর্বর উষ্ণতা আর পুষ্পাঞ্জলি ও গানের সুর নিশ্চিতভাবে মৃত ও নষ্টের অবশ্যম্ভাবী পুনর্জাগরণের আনন্দোৎসব।
ইখানে আস্যেই টুসু-র সঙ্গে হামার দেখা হল
টুসুর দিন থেকেই শুরু অজস্র মেলা। নানা জায়গায়। মহাদেববেড়্যার মেলায় হাজার হাজার লোক। দেদার বিকোচ্ছে শিরকাবাদী ও স্থানীয় আখ। ক্লান্ত হয়ে কত দিন পর দাঁতে ছাড়িয়ে সেই সুমিষ্ট আখের রস খেলাম। আর সেদ্ধ ডিম। গাদা গাদা বিক্রি হচ্ছে। শিশু-জুয়ার মালিক চাকা ঘুরোচ্ছে। যদি নির্দিষ্ট নম্বরে এসে চাকা থামে আর সেই নম্বরে থাকে তিন তিনটে সেদ্ধ ডিম, তাহলে কি আকাশছোঁয়া হর্ষধ্বনি! এ ছাড়া ভাবরা ভাজা, চপ, বেলুন কত কী। টেরি বাগানো রংবেরঙের টি শার্ট পরা ছেলের দল টুসুনিদের পিছু পিছু নদীর ধার অব্দি যাবেই। যেতে যেতে নিজেদের মধ্যে, কিন্তু শুনিয়ে শুনিয়ে অকথা কুকথা বলবে না এরকম কোনও গ্যারান্টি নেই। অনেক প্রেমে পড়বার কেসও ঘটে টুসুর আশীর্বাদে।
চৌডলের এখন প্রচুর রকমফের। ষোলোশো টাকা অব্দি দেখে এসেছি। সোনালী রূপোলী চিকচিকে কাগজ, পুঁতি, জরিতে সজ্জিত সে চৌডল যখন টুসুনিদের হাতে আকাশে উঠে সারা অঙ্গে মেখে নেয় শীতের হলুদ রোদ, তখন দিব্যি লাগে। প্রাণে ধরে জলে ফেলা মুস্কিল। তবে মেলায় দোকানি, জুয়াড়ি সবাই মা বোনেদের নিন্দেমন্দ করেছেন। আগে ভোর রাতে শুরু হত টুসুযাত্রা, বেলা বারোটার আগেই সব শেষ। কিন্তু এখন হামদের মা বুনেরা না খায়ে বাহিরে কোথাও যায় না! সিনান নাহান করে খায়ে দায়ে বেলা বাইড়লে টুসু নিয়ে নদীর ধারে আসবেক। তখন ভিড় জম্যে উঠবেক।
তাতে কার অসুবিধে বুঝিনি। তবে এও কানে এল অনেক বাড়ি থেকে টুসু করবার রীতি উঠে যাচ্ছে, কারণ কলেজপড়ুয়া বা চাকরিকরা মেয়েরা অনেকে সময়ের বা ইচ্ছের অভাবের কথা সজোরে ব্যক্ত করছেন। গান গাইতে গাইতে নদীর তীর পর্যন্ত যাওয়া তাদের না-পসন্দ।
পৃথিবীর এইসব প্রাচীন ব্রতকথা, কৌম আচার, যাবতীয় শ্রমোৎসব নিয়ে আমি সর্বদাই দ্বিধায় থাকি। কংসাবতীর তীরে পলাশগাছের ছায়ায় বসে মনে হয় এরা লুপ্ত হয়ে গেলে চারপাশ আরও খানিকটা রিক্ত হবে। কিন্তু সময়ের অপচয় ধরে নিয়ে কোন গ্রামীণ মেয়ে যদি ভাবে এই এক মাস সে কম্পিউটার শিখবে, তাকে উৎসাহ না দেবার কারণ থাকে না। তাই সময়ের দাবিতে টুসু বা ভাদু উৎসবের আয়ু যদি নির্দিষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে তাকে মেনে নেওয়াই বোধহয় ভালো। সারা বেলা উপোস করে থাকা টুসুনিদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর একথা জানে না ব’লে এক মেলা লোক হাহাকার করছে— এ বড় শ্রুতিমধুর নয়।
তাই টুসু ডাকলে চটজলদি সাড়া দেওয়াই ভালো। আমরা যাচ্ছি যাব করতে করতে ভারতবর্ষের এই আমূল ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবের ভিত যেন না নড়ে যায় পুরুলিয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়ানো বহুপ্রাচীন জৈন মন্দিরগুলির মতো। টুসু ব্রত করতে পারে সবাই। আদিবাসী, মুসলমান, বর্ণহিন্দু— সমস্ত ঘর থেকেই টুসুনিরা আসে। কোনও সমাজপতি আপত্তি করে না, কোনও বহতা ধারা অপবিত্র হয় না। এইরকম আর কোনও সঠিক অর্থে সর্বজনীন উৎসবের কথা আমার জানা নেই। মানভূমের ‘মকরের ডুব’ আর টুসুগীত তাই এখনকার ভারতবর্ষের গভীরতর অসুখের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে।
টুসু যেন আমায় বার বার ডাকে!