![nilanjan](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2019/10/nilanjan.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
নীলাঞ্জন হাজরা
দ্বিতীয় পর্বের পর
শিল্পীর দায়
শিল্পীরা যখন হীরকরাজের পারিষদের মতো কেবল ঘাড় নাড়েন, সমাজের তখন গভীর গভীরতর অসুখ৷ পশ্চিমবঙ্গের আজ গভীর অসুখ৷
কথাটা কেন মনে এল? বলছি৷ তার আগে ওপরের ছবিটা দেখুন৷ আর একবার দেখুন৷ দরকার হলে আরও একবার দেখুন৷ শিল্পী জর্জ ইনেস (১৮২৫ – ১৮৯৪)৷ ছবির নাম— দ্য লাকাওয়ানা ভ্যালি৷ ১৮৫৬ সাধারণাব্দে আঁকা৷ ক্যানভাসে তেল রং৷ ৮৬ × ১২৭.৫ সেন্টিমিটার৷
ওয়াশিংটন ডিসি-র ন্যাশনাল আর্ট গ্যলারি-র জাদু(ঘর)-দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছি৷ ঘুরছি এক গাইড ভদ্রমহিলার সঙ্গে৷ তিনি এক একটি পেন্টিংয়ের সামনে দাঁড়াচ্ছেন এবং অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করছেন— আমার প্রায় চিত্রকলা-অন্ধ বোধে ছবিগুলির গুণাবলি ঢোকানোর চেষ্টা করছেন৷ আমি বাধা দিচ্ছি না৷ পরাজয়ের গ্লানিও মানুষের মাঝে সাঝে অনুভব করা দরকার৷ কী যেন বলে? Failures are the pillars of success! কাজেই ভদ্রমহিলার বড় উপকারই করছি৷
এহেন প্রচেষ্টায় তিনি জর্জ ইনেস-এর ছবিটির সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ জর্জ ইনেস যথেষ্ট বিখ্যাত মার্কিন পেন্টার৷ কিন্তু ততও বিখ্যাত নন যে, শিল্পবোদ্ধা হই বা না হই নাম শুনেই আটকে যাব৷ তবু গাইড দাঁড়ালেন৷ আমিও দাঁড়ালুম৷ এবং চোখ আটকে গেল৷ ছবিটায় কী একটা যেন গোলমাল আছে? টেকনিকের গোলমাল না৷ তেমন গোলমাল থেকে থাকলেও তা বোঝার চোখ বা তালিম কোনওটাই আমার নেই৷ কিন্তু চোখ বলছে— সামথিং ইজ রং হিয়ার!
কী ‘রং’? Subversion-এর রং! জাত শিল্পীর— তা তাঁর শিল্প যাই হোক না কেন— পেন্টিং, সাহিত্য, সিনেমা, নাটক— জাত শিল্পীর সব থেকে বড় হাতিয়ার— সাবভার্শন৷ ভেঙে বলতে গেলে, একটু বেয়াদপি ভাষায়, ক্ষমতার বিরুদ্ধে তলায় তলায় হারামিগিরি৷ তা সে ক্ষমতা যেমনই হোক না কেন— রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক৷ তলায় তলায় কেটে বেরিয়ে যাওয়া৷ চট করে খেয়াল হবে না, কিন্তু— ‘সমঝদারোঁ কে লিয়ে ইশারা কাফি!’ এই ছবিটাতে তথাকথিত ‘আমেরিকান ড্রিম’-কে চ্যালেঞ্জ করে দিয়েছেন শিল্পী৷ সেই ‘মার্কিন স্বপ্ন’ আজ অবধি প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনও না কোনও সময়ে যা কপচেছেন, কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়নের শ্রেষ্ঠত্বের দিকে ধেয়ে চলেছে তা প্রমাণ করতে৷ এই ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর ঊনবিংশ শতকে ভিত্তি ছিল বেসরকারি পুঁজির বিনিয়োগে শিল্প বিপ্লবের (ইনডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন) সব ফসল ইউরোপ থেকে আমদানি করা এবং তা ছাড়িয়ে আরও এগিয়ে যাওয়া৷ চ্যালেঞ্জ করে দিলেন ইনেস, এই ছবিতে, যা সাধারণত ধরা হয় তাঁর সব থেকে বিখ্যাত সৃষ্টি হিসেবে৷
জর্জ ইনেস-কে এই ছবিটা আঁকার বরাত দিয়েছিলেন জন জে ফেলপ্স, ডেলাওয়্যার ল্যাকাওয়ানা অ্যান্ড ওয়েস্টর্ন রেলরোড কোম্পানির প্রেসিডেন্ট৷ বাফেলো, নিউ ইয়র্ক, হোবোকেন, নিউ জার্সিতে রেল যোগাযোগের দায়িত্ব ছিল সে কোম্পানির৷ কাজটি যে কত ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে তার উদ্যাপন অমর করে রাখতেই বিখ্যাত শিল্পীকে এই পেন্টিংয়ের বরাত৷ কাজটি নিয়েছিলেন শিল্পী৷ মন দিয়ে এঁকেছিলেন৷ কোম্পানির মন পসন্দ্ সব কিছুই আছে এতে— দূরে বাঁ দিকে শহর তৈরি হচ্ছে৷ ডান দিকে রেলের বড়সড় ইয়ার্ড৷ সাদা ধোঁয়া উড়িয়ে ধেয়ে আসছে কালো ইঞ্জিন-টানা ট্রেন৷ এক্কেবারে আমাদের এখানের সেই আদিবাসী লোকসঙ্গীতের কলি যেন— চল দেখে আসি রেলগাড়ি ক্যাইসন সুন্দর / উপ্রেতে লোহা-লকড়ি, ভিত্রেতে আগ-পানি / হাওয়াকে সমান চলে, লাগে নধর শ্যাম! এক্কেবারে সেই ছবি৷ তাই না?
না৷ এবারে সামনেটা ভালো করে দেখুন৷ সারাটা জায়গা ভর্তি কেটে ফেলা গাছের ছোট ছোট গুঁড়ি৷ ছবিটাকে ভাগ করলে দেখা যাবে, আকাশ বাদ দিলে, জমিন যেটা— যেখানে নাকি এই তাক লাগানো উন্নয়ন, তার অর্ধেক রেল-গাড়ি, শহর এই সব (উন্নয়ন) বাকি অর্ধেক, একেবারে সামনের অর্ধেক যা ফ্রেমের বাইরে ভবিষ্যতের দিকে চলে গেছে, সেই অর্ধেক কাটা কাটা গাছের গুঁড়িতে ভরা৷ আর সেই অমোঘ নিয়তির দিকে তাকিয়ে রয়েছে একেবারে সামনে একটি অপূর্ব সুন্দর ঝাপ-ঝুপো সবুজ গাছ!
উন্নয়নের সাফল্যে ডগমগ কোম্পানি প্রেসিডেন্ট কি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর সাফল্যের উদ্যাপন উপলক্ষে কী বার্তা রেখে যাচ্ছেন শিল্পী? চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় উন্নয়নের হিড়িকে প্রকৃতির ওপর কী ভয়ঙ্কর হামলা শানাচ্ছে কর্পোরেট দুনিয়া৷ শিল্পীকে ভর্ৎসনার কোনও নথি তো নেই৷ আসলে এমনই জাত শিল্পীর জাত সাবভার্শন! দেড়শো বছর পর সে ছবির ‘নোট’-এ মার্কিন ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি-কে লিখে দিতেই হয়— ‘Although it was initially commissioned as an homage to the machine, Inness’ Lackawanna Valley nevertheless serves as a poignant pictorial reminder of the ephemeral nature of the American Dream.’
এই সাবভার্শন নতুন নয়৷ জাত শিল্পী চুপ করে থাকেন না৷ থাকতে পারেন না৷ কলকাতার একের পর এক ফ্রেসকো, মিউরাল, স্কাল্পচার সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাম জমানায় তৈরি বলে৷ তার জায়গা নেবে কদর্য এমন কিছু— কী বলব? শিল্প বলাও অপরাধ— এমন কিছু নকল-নবিশি৷ অথচ কেউ কিচ্ছুটি বলবে না৷ এই সিরিজটা লেখাটার তাগিদেই পুরনো ছবি ঘাঁটতে ঘাঁটতে জর্জ ইনেস-এর পেন্টিংয়ের ওই ছবিটা বেরিয়ে পড়ল৷ আর তখনই মনে এল আমাদের পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীকুলের এই পাথর-নীরবতার কথা৷ এ নীরবতা গভীর অসুখের৷
শার্লকের শহরে
Come, Watson, come. The game is afoot. ব্রেক্সিট-এর তোলপাড় কাণ্ড শুনে কি স্বভাবসিদ্ধ উত্তেজনায় দু’হাত ছুড়ে এ কথাই বলতেন বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা শার্লক হোমস? নাকি এমন একটা সাংঘাতিক কাণ্ড যে ঘটে গেল তা তাঁর অ্যান্টেনাতে ধরাই পড়ত না— ব্রেক্সিট? সেটা আবার কী?
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রিটেন৷ ভালো হবে না মন্দ হবে? জানি না৷ সত্যি বলতে কী যেটুকু খবরে দেখেছি ওপর ওপর তার বাইরে ঘেঁটেঘুঁটে কিছু জানতেও চাই না৷ চাই না কারণ আমার লন্ডনের অভিজ্ঞতা ভালো নয়৷ বহু বহু বছর আগে আমেরিকা থেকে ফেরার পথে লন্ডনে মাত্র দিন সাতেক ছিলাম, এবং তখনই ঠিক করেছিলাম আর কখনও এ শহরে ফিরব না৷ লন্ডনই সেই দুটি পশ্চিমি শহরের একটি যেখানে আমি সাত দিনে বার তিনেক বিদেশি-বিদ্বেষ, যাকে জেনোফোবিয়া বলে, তার মুখোমুখি হয়েছিলাম৷ আর একবার তার মুখোমুখি হয়েছিলাম ভিয়েনায়৷
আমি কিন্তু অনেক আশা নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলাম৷ উঠেছিলাম বিবিসি-র এক বাঙালি সাংবাদিকের বাড়িতে৷ কাজেই থাকার কোনও অসুবিধা হয়নি৷ সকাল সকাল বেরিয়ে সারা দিন টো-টো করে ঘুরে বেশ রাতে বাড়ি ফিরতাম৷ রাস্তায় নিরাপত্তার অভাবও কোনও দিন বোধ করিনি৷ কিন্তু প্রথম দিন থেকেই মনে হয়েছিল— সুর লাগছে না৷ সুরটা ঠিক লাগছে না৷ শহরটা যেন আমাকে চাইছে না৷ আসলে ধাক্কাটা খেয়ে গিয়েছিলাম একদম শুরুতেই৷
মনের মধ্যে এই একটা দ্বন্দ্ব ছিল— সত্য আগে না কল্পনা আগে? মার্ক্স আগে না হোমস আগে? মানে, লন্ডনে পৌঁছে আগে কোথায় ছুটব? ব্রিটিশ মিউজিয়াম? যেখানে কাচে ঘিরে রাখা আছে কার্ল মার্ক্স যে চেয়ারে বসে বছরের পর বছর পড়াশুনো করেছেন? নাকি ২২১বি বেকার স্ট্রিট? যেখানে থাকতেন ফেলুদার গুরু? শেষ পর্যন্ত সত্যকে হারিয়ে কল্পনাই জিতে গেল৷
ছুটলুম৷ টিউব-এ চড়ে৷ লন্ডনে মেট্রোকে বলে টিউব৷ স্টেশনের নাম বেকার স্ট্রিট৷ যদ্দূর মনে পড়ছে স্টেশন থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে ঘুরে মিনিট দু’-তিন হাঁটলেই সেই মহা-ঠিকানা— ২২১বি৷ কিন্তু তখন তো আর তা জানতাম না৷ টিউব থেকে বেরিয়েই দেখি বৃদ্ধ এক খবরের কাগজ বিক্রেতা পসার ছড়িয়ে বসে আছেন৷ দেখেই বোঝা যায় বহু বছর ধরে তিনি এখানে বসেই কাগজ বিক্রি করে চলেছেন৷ তাঁকে বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করি— শার্লক হোমস মিউজিয়ামটা কোথায় বলতে পারেন? ছবির মতো মনে আছে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন— ‘আই অ্যাম অ্যাফ্রেড, নো ওয়ান এভার টোল্ড মি হোয়্যার ইট ইজ!’ সঙ্গে যেভাবে আমার দিকে তাকালেন তার একটা খাসা ইংরেজি আছে— ‘ন্যাস্টি লুক’৷ মনে আছে, আমি সম্পূর্ণ উল্টো দিকে মিনিট দশেক হেঁটে, বোকার মতো বহু খোঁজাখুঁজি করে তবে ২২১বি-তে পৌঁছে ছিলাম৷ তবে এটাও ঠিক, সে দরজায় পৌঁছতেই মনের মধ্যে যে একটা দুঃখ মাখা তিক্ততা তৈরি হয়েছিল সেটা একদম হাওয়া হয়ে গেল৷
মুখেই গোয়েন্দা প্রবরের এক বিরাট ব্রোঞ্জের মূর্তি৷ ঢুকতে টিকিট লাগল৷ সস্তা নয়৷ আজ আর ঠিক মনে নেই তবে ১৫ পাউন্ডের কাছাকাছি৷ শার্লক হোমস-এর জন্ম ১৮৫৪ সালের ৬ জানুয়ারি৷ এ বাড়িতে তিনি তাঁর দোসর ডক্টর ওয়াটসনের সঙ্গে ভাড়া থাকতেন ১৮৮১ থেকে ১৯০৪৷ বাড়ির মালকিন ছিলেন মিসেস হাডসন৷ দরজায় দাঁড়াতেই একটা শিহরণ হল৷ জানি সবই কল্পনা৷ কিন্তু সেই বোধ হয় ক্লাস ফোর থেকে পড়তে পড়তে তার পর বিবিসি-প্রযোজিত জেরেমি ব্রেট-এর করা ফিল্মগুলো দেখতে দেখতে (বলতে দ্বিধা নেই, ডেভিড কামবারব্যাচ-কে আমি হোমস হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারি না) প্রত্যেকটা চরিত্র যেন কত কালের চেনা হয়ে গিয়েছিল৷
সেই জানালা৷ সেই টেবিল৷ সেই আর্মচেয়ার (সে চেয়ারে ইচ্ছে হলে মিউজিয়াম দর্শনার্থী বসে সাধ মেটাতেও পারেন)৷ অনেক ছবি তুলে ছিলাম৷ কিন্তু আমার একটা বড় খেদ, ওই চেয়ারটায় বসে কাউকে অনুরোধ করে আমার একটা ছবি তুলিয়ে রাখিনি৷ পাইপ, টুপি, বেহালা, ট্যাঁক ঘড়ি, টাইম পিস, গ্যাস লাইট, ছুরি, টেপ, বিকার, টেস্ট-টিউব, বুনসেন বার্নার, আতস কাচ— কী নেই? মায় গোয়েন্দা আর তাঁর শাগরেদের সুটকেস, পরিপাটি করে লেখা ডায়েরিগুলো পর্যন্ত৷ সরু সিঁড়ি বেয়ে দো-তলায় উঠেই হোমস-এর সেই বিখ্যাত স্টাডি৷ তিন তলায় ওয়াটসন আর বাড়ির মালকিন মিসেস হাডসনের ঘর৷ অবিশ্বাস্য! মজার কথা হল এই মিউজিয়ামের ঠিকানায় এখনও শত শত চিঠি আসে শার্লক হোমস-এর নামে! ভাবলে দুঃখ লাগে, ফেলুদা-র নামে এ রকম একটু মিউজিয়ামের পুঙ্খানুপুঙ্খ প্ল্যান নিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী বৈশাখী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি, একজনও স্পনসর পাইনি৷
মিউজিয়ামে রয়েছে একটি ছোট সুভেনির শপ-ও৷ সে দোকান থেকে হোমস-এর ব্যবহৃত নানা টুকিটাকি জিনিসের নকল কিনে নিতে পারেন দর্শনার্থীরা৷ অনেক পরে বৈশাখী ব্রিটেনে পড়াশুনা করার সময়, সেখান থেকে আমার জন্য কিনে এনেছিল একটি অপূর্ব ক্যালাবাশ পাইপ৷ হোমসের দেখাদেখি, আমিও বিভিন্ন পাইপের একটা ছোটখাটো কালেকশন তৈরি করেছি৷ কাঠের পাইপ— ব্রায়ার, রোজউড, পেয়ারউড— কাচের পাইপ, পোখারার কাছে তিব্বতিদের বসতি থেকে কেনা ধাতুর পাইপ, ভুট্টার ভেতরের অংশটা দিয়ে তৈরি পাইপ— যাকে ‘কর্ন কব’ বলে— হাফ বেন্ড, ফুল বেন্ড, স্ট্রেট, লার্জ বোল, মিডিয়াম বোল, স্মল বোল, চার্চওয়ার্ডেন…৷ ক্যালাবাশটি সে কালেকশনে মূল্যবান যোগ৷
খাস ক্যালাবাশ পাইপ-এর মূল কাঠের মতো অংশটা তৈরি হয় ক্যালাবাশ নামক এক প্রকারের সরু লাউ থেকে৷ ঠিক যেমন আমাদের দেশে লাউ শুকিয়ে তার খোলটা পালিশ করে সেতারে ব্যবহার করা হয়, ক্যালাবাশ পাইপ তারই একটা মিনি ভার্শন বলা যায়৷ তবে এখন আর সব সময় সেই ক্যালাবাশ লাউয়ের খোল ব্যবহার করা হয় না৷ তার জায়গায় ব্যবহৃত হয়, আফ্রিকান মেহগনি কাঠ৷ আমার ক্যালাবাশটাও তাই৷ আর পাইপের যে বোল-টা, বাটিটা, যেটাতে তামাকটা পুরতে হয়, সেটা তৈরি হয় তুরস্কের এক রকম মাটি দিয়ে৷ চিনেমাটির মতো অনেকটা৷ একে বলে মিরশুম৷ পাইপ ব্যবহার হতে হতে মিরশুমটা সাদা থেকে সোনালি হয়ে যায় আগুনে পুড়ে৷ আর ক্যালাবাশ সব সময়েই বিগ-বোল পাইপ৷ মজার কথা হল, হোমস-এর যে গল্প-উপন্যাসগুলি লিখেছিলেন আর্থার কোনান ডয়াল, তার কোথাও কিন্তু হোমস ক্যালাবাশ ব্যবহার করছেন, এমন কোনও উল্লেখ নেই৷ সেটা ঢুকে পড়ে জেরেমি ব্রেট যখন হোমস-এর চরিত্রে অভিনয় করছিলেন ফিল্মগুলিতে৷ অন্য ধরনের পাইপের বোল কিছুক্ষণের মধ্যেই গরম হয়ে যায় বলে, অনেকক্ষণ সেটি হাতে ধরে থাকা তাঁর পক্ষে সমস্যা হচ্ছিল৷ তখনই ঠিক হয় তাঁর হাতে ক্যালাবাশ ধরানো হবে৷
ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে৷ গণভোটে ব্রিটেনের বৃদ্ধরা ঢেলে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন৷ এর ফলে নাকি অন্য দেশ থেকে ব্রিটেনে গিয়ে পাকাপাকি বসবাস খুব কঠিন হয়ে পড়বে৷ দলে দলে বাইরের লোক এসে ইংল্যান্ডে ডেরা বাঁধুক এটা বহু ইংরেজের ঘোর না-পসন্দ্৷ মনে পড়ছে আমাকে পথ না-দেখানো সেই বুড়োর কথা!
ছোট্ট শেমিজ পরা জাহাজে
দুনিয়া জুড়ে ‘কখনও সূর্য অস্ত না যাওয়া’ (কারণ বিশ্বের দুই গোলার্ধ জুড়ে এত বিস্তৃত ছিল সে উপনিবেশ, যে তার অধীনস্থ এক দেশে যখন রাত হচ্ছে অন্য আর এক দেশে তখন সূর্যোদয়ের সময়) ব্রিটিশ উপনিবেশের ইতিহাসের কেন্দ্রীয় শহর লন্ডনের সুরের সঙ্গে আমার সুর কিছুতেই মিলছিল না৷ অভিজ্ঞতাও খুব ভালো হয়নি৷ তবু, ওই লন্ডনেই মিটেছিল আমার বহু দিনের একটা সাধ— খানিকটা দুধের সাধ ঘোলে মেটার মতো হলেও৷ সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা৷ জীবনে কখনও জাহাজে উঠিনি৷ সেটা উঠেছিলাম৷ যদিও সে জাহাজ তখন আর চলে না৷ কাটি সার্ক৷
ঠিক খাস লন্ডনে নয়৷ লন্ডনের শহরতলি বলা যায়— গ্রিনউইচে৷ ঠিক৷ সেই গ্রিনউইচ, যার থেকে এসেছে ‘গ্রিনউইচ মিন টাইম’৷ যেখান দিয়ে গিয়েছে পৃথিবীর 0 ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ৷ মূলমধ্যরেখা, যাকে বলে ‘প্রাইম মেরিডিয়ান’৷ যে কল্পিত রেখার একটা অংশ মাটিতে দাগ দিয়ে নালার মতো খুঁড়ে ইস্পাত আর কাচ দিয়ে বাঁধানো আছে রয়াল অবজার্ভেটরি-র মাঠে৷ আর যার ওপরে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে ছবি তুলে আপনি বলতে পারেন— আমার এক পা পূর্ব গোলার্ধ আর এক পা পশ্চিম গোলার্ধে! সেই অবজার্ভেটরির সুভেনির শপ-এ যে অজস্র রকমের ঘড়ি বিক্রি হয় তা দেখে তাক লেগে গিয়েছিল৷ লোভে পড়ে সাধ্যের বাইরে গিয়ে কিনেও ফেলেছিলাম একটা অদ্ভুত টাইম-পিস্! সেটার নাম ‘টাইম মেশিন’৷ রয়্যাল অবজার্ভেটরিতে অবিশ্যি মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণার কাজ বিশেষ কিছু হয় না, এটি এখন প্রধানত জাদুঘর। সেখানে কাটিয়ে ছিলাম খানিকটা সময় ঠিকই কিন্তু যেহেতু কী যে দেখেছিলাম তার কিছুই মনে করতে পারছি না, ধরে নিচ্ছি তার কোনও দ্রষ্টব্যই আমার মন টানেনি।
মন টানল তার বাইরের দৃশ্য। এই রয়াল অবজার্ভেটরি একটা ছোট্ট টিলার উপর৷ সেখান থেকে এঁকে বেঁকে নেমে গিয়ে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে গাঢ় সবুজ একটা বিপুল মাঠের মধ্যে দিয়ে৷ আর তার ওই পারে ন্যাশনাল ম্যারিটাইম মিউজিয়াম, আর তারও পিছনে আদিগন্ত ছড়িয়ে রয়েছে সারাটা লন্ডন শহর, সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে টেম্স। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য— পুরোভাগে মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের বনেদিয়ানা আর তার পিছনে ছড়িয়ে আছে আধুনিক লন্ডনের হাইরাইজের উদ্ধত আস্ফালন।
তার ওই পাশে ন্যাশনাল ম্যারিটাইম মিউজিয়াম৷ আর তারই পিছনে নোঙ্গর করা আছে সেই জাহাজ— কাটি সার্ক! যে জাহাজের বিষয়ে রয়াল মিউজিয়ামস (গ্রিনউইচ)-এর সরকারি মন্তব্য— legendary sailing ship Cutty Sark, the world’s sole surviving tea clipper, and fastest ship of her time.
কোন ‘টাইম’? ঊনবিংশ শতক৷ কাটি সার্ক তৈরি হয় ১৮৬৯ সাধারণাব্দে৷ স্কটল্যান্ডের ডাম্বার্টন-এ৷ পাল তোলা এই জাহাজের যে জাত তাকে বলে ‘ক্লিপার’৷ তিনটি বিশাল বিশাল মাস্তুলে বাঁধা তার পাল৷ পূর্ব ভারত থেকে আনা সেগুন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা ‘রক এল্ম’ গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি হয় এর খোল৷ জোর দেওয়া হয়েছিল এমনভাবে তৈরির ওপর যাতে সাগর-মহাসাগরের উত্তাল বাতাস ৩২টি পালের ডানায় নিয়ে পাহাড় প্রমাণ ঢেউ কেটেও সোঁ-সোঁ করে ছুটতে পারে জাহাজ৷ সেই যে আমাদের উত্তরবঙ্গের সারিগানে আছে— ‘বৈঠা না পালাইতে পারে, শূন্যে দাওরে উড়া / ও জলের ঘুড়া, দৌড়াইয়া যাও!’
উদ্দেশ্য, চিন দেশ থেকে জাহাজ ভর্তি চা নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ইংল্যান্ডে তা পৌঁছে দেওয়া৷ কিন্তু সে জাহাজের এমন আজগুবি নাম কেন? কাটি সার্ক— এ কেমন ইংরেজি শব্দ? আসলে শব্দ দুটো ঠিক ইংরেজি নয়৷ স্কট৷ সার্ক মানে মেয়েদের সেই পরিধান, যাকে বলে ‘শেমিজ’৷ আর ‘কাটি’ হল ছোট্ট৷ ১৭৯১ সাধারণাব্দে স্কটিশ কবি রবর্ট বার্ন্স একটা দীর্ঘ কবিতা লেখেন— Tam O’ Shanter৷ সেই কবিতায় ছিল এক ডাইনি৷ সে কেবল পরে থাকত একটা ছোট্ট শেমিজ— কাটি সার্ক৷ তাই তার নামই হয়ে গিয়েছিল কাটি সার্ক৷ ঊনবিংশ শতকে প্রত্যেক জাহাজের সামনে থাকত একটা মূর্তি— জাহাজের ‘ফিগারহেড’৷ কাটি সার্ক জাহাজ যখন প্রথম তৈরি হয়, তার ‘ফিগারহেড’ হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল সেই ডাইনি কাটি সার্ক-এর একটা প্রতিকৃতি৷ সেই থেকেই জাহাজটির নাম হয়ে গেল কাটি সার্ক৷
১৮৭০-এর ২ ফেব্রুয়ারি লন্ডন বন্দর থেকে দুগ্গা-দুগ্গা বলে ভেসে পড়ল কাটি সার্ক৷ লক্ষ্য সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপ ঘুরে চিনের সাংঘাই৷ খোল ভরা হরেক কিসিমের মদ৷ সাংঘাই বন্দরে পৌঁছল ২ জুন৷ ফিরতি পথে সাংঘাই থেকে ২৫ জুন ১৩০৫৮১২ পাউন্ড চা নিয়ে লন্ডন বন্দরে এসে ভিড়ল ১৩ অক্টোবর৷ ক্যাপ্টেন ছিলেন— জর্জ মুডি৷ এই ছিল কাটি সার্ক-এর প্রথম সাগর পাড়ির যাতায়াত৷
তার পরে বহু ঝড় ঝাপটা গিয়েছে কাটি সার্ক-এর ওপর দিয়ে৷ মাঝ সমুদ্রে মাস্তুল ভেঙে পড়া, খুন, মাল্লাদের বিদ্রোহ— কী দেখেনি কাটি সার্ক? তবু অন্তত দশ বছর সমুদ্রের অবিসংবাদিত রাজা৷
আমি যখন সে জাহাজে উঠেছিলাম তখনও তা বেশ অক্ষত৷ ঘুরে ঘুরে দেখেছি আর কল্পনা করার চেষ্টা করেছি স্টিমশিপ চালু হওয়ার আগের যুগে চালু হয়ে, এমনকী তার পরেও কিছু কাল, প্রাচীন পদ্ধতিতে পাল তুলে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছে সে জাহাজ৷ সে সময় এমন গুরুত্বপূর্ণ জাহাজের ক্যাপ্টেন মানে দোর্দণ্ড প্রতাপ, সেই ক্যাপ্টেনের কেবিনে ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম৷ একরত্তি সে কেবিনে কীভাবে কাটাতে পারে একটা মানুষ মাসের পর মাস? আর তার অন্ধকার এক পাশে সাধারণ মাঝি-মাল্লাদের থাকার ব্যবস্থা৷ সমুদ্রের দারুণ বাতাসে কীভাবে দড়ি দিয়ে টেনে টেনে টাঙানো হত অতগুলো পাল সেও এক বিস্ময়ের ব্যাযপার৷ সব মিলিয়ে অদ্ভুত শিহরণ বোধ করেছিলুম৷ তারপর এই কয়েক বছর আগে কাগজে পড়লাম, বিধ্বংসী আগুনে অনেকটাই পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে কাটি সার্ক৷
(চলবে)