উঠা হ্যাঁয় তুফান জামানা বদল রাহা

শঙ্কর রায়

 


সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

পঞ্জাবের বাথিন্ডা জেলার গুরমাইল কৌর ও বারনালা জেলার রাজিন্দর কৌর দুই মহীয়সী শহীদ— কৃষক স্বার্থবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী তিন কৃষি আইনের প্রতিবাদ আন্দোলনের এই দুই শহীদ আমাদের (বিশেষ করে বাংলার গজদন্তমিনার নিবাসী উন্নাসিকদের) শূন্যগর্ভ বিপ্লবীয়ানাকে কশাঘাত করেছেন। ভারতের রাজধানীর উপকণ্ঠে এসে এঁরা জানালেন কৃষি পরিবারের মহিলারাদের কাছেও জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য। যেমন বারনালা জেলারই কাহান সিং ও জনক রাজ, সাঙরুর জেলার কার্নাইল সিং ও লাখবির সিং-এর মতো অন্যান্য জেলার আরও অন্তত দশ কৃষিজীবীর প্রাণ বিসর্জনে যেন জেগে উঠেছে অবিস্মরণীয় কণ্ঠশিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গাওয়া, প্রবীর মজুমদারের লেখা ও সুরারোপিত গানের কলি ‘মাটিতেই জন্ম নিলাম/মাটি তাই রক্তে মিশেছে’। বেশরম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের তাতে কিছু যায় আসে না। করোনা-ত্রাসে লকডাউনের আগে তাঁদের মদতে দিল্লিরই শাহিনবাগে ৫৩ জন নিরস্ত্র ও বিবেকী মানুষের নাৎসিবাদ-অনুপ্রাণিত নারকীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ আইন প্রণয়নের প্রতিবাদে মৃত্যুতেও এদের হেলদোল দেখা যায়নি। সারা দুনিয়ার মানুষ ভুলে যাননি ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গা যাতে দু হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন, সে রাজ্যের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নির্বিবেকী মোদিজি সেজন্যে পদত্যাগ করেননি, করার প্রশ্নই ছিল না, কারণ এরা হিটলার-মুসোলিনির অবৈধ রাজনৈতিক সন্তান।

আরএসএস-এর ছকে ঘটেছিল ওই নিধনযজ্ঞ। মোদি ও শাহ আরএসএস-প্রশিক্ষিত, যারা ধর্মের ভিত্তিতে মেরুকরণ ও বিভাজনের চক্রান্ত রূপায়ণে নিবেদিত প্রাণ। পনেরো-বিশ-তিরিশ কৃষকের প্রাণের কী দাম এদের কাছে?

তথাচ এত শহীদের আত্মবলিদান এই মহা-আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছে। এই তিনটি আইন— The Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Act, 2020, the Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Act, 2020, and the Essential Commodities (Amendment) Act, 2020.— (যা রূপায়ণে অত্যাবশ্যক নিয়মাবলি এখনও প্রতীক্ষিত) হিন্দুত্বের কাঠামোভুক্ত। চরম প্রতিক্রিয়াশীল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এগুলির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিল, যদিও সেই মামলা এতই বালখিল্য যে প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবদে এক কথায় নাকচ করে দিয়েছিলেন। বর্তমান সুপ্রিম কোর্ট শাসক বিজেপির প্রতি স্বভাবরুষ্ট, তা সঙ্ঘ পরিবারের প্রতি অত্যানুরক্তও বলবেন না, কিন্তু বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পিছনে যে সঙ্ঘ পরিবার ছিল, এ বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। ‘দিল্লি চলো’ অভিযান হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষমতান্ধতা ও ঔদ্ধত্যের পরিবাষ্প চূর্ণ করে দিয়েছে’— আইআইটির প্রাক্তনী ও লেখক আমনদীপ সান্ধুর পাঞ্জাব টুডে টিভি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি লেখার শিরোনাম। তিনি সক্ষোভে লিখেছেন, প্রতিবাদীরা ভারতের সংবিধানের মৌলিক অধিকারমালার ১৯ ধারা বলে বাক ও বাকস্বাধীনতার অধিকার, শান্তিপূর্ণভাবে এবং নিরস্ত্রভাবে একত্রে শামিল হওয়ার স্বাধীনতা ভারতের সর্বত্র অবাধে চলাচল করার অধিকার বলে জাতীয় রাজধানীতে পৌঁছানোর সংকল্প-প্রয়াস নানাভাবে বানচাল করার চেষ্টা করছে হরিয়ানার বিজেপি-নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার। মিছিলকারী কৃষক, শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ী, পুরুষ, মহিলা, শিশু, প্রবীণেরা হরিয়ানা পুলিশের শিকার। উপরন্তূ প্রতিরক্ষা বাহিনী পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে যে আন্তর্জাতিক সীমান্তে তৈরি করেছে যে মতো লোহার

কাঁটাতারে বড় বড় পাথরের গভীর পরিখা করে জলকামান এবং কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করে বাধা দিচ্ছে।

’বেশরম ‘হিন্দুত্ববাদী’ রাজনীতির প্রকট প্রকাশ কাপুরুষতার প্রতি। এসবে সংগ্রামী কৃষকদের মনোবল ভাঙা যায়নি। কনকনে ঠান্ডার মধ্যেও নিজেদের অবস্থানে অনড়। তাঁদের প্রতি সহমর্মী যাত্রাপথের ধারে বসবাসকারী ও অবস্থান স্থলের নিম্নবিত্ত মানুষজন। অবশ্য হরিয়ানার গেরুয়া মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খত্তরের অহংকার চূর্ণ করেছেন বাহাদুর কৃষকেরা। তাঁরা ওইসব বাধা-ব্যারিকেড ভেঙ্গে এগিয়ে চলেছেন। সান্ধু লিখেছেন ‘অবাক হয়েছি তাঁদের প্রতিহত করার মানদিকতা, বোধবুদ্ধি মমত্ববোধে, মানবিকতায়। প্রতিবাদীরা পুলিশদেরও খাবার ও পানীয় জল সরবরাহ করেছেন।প্রতিবাদীরা ফিরিয়ে এনেছেন এমন কিছু অনেক বছর যেন হারিয়ে গিয়েছিল।’এদিকে খত্তরের গদি যায়। বিজেপির সহযোগী দল জননায়ক জনতা পার্টি-প্রধান ও উপ-মুখ্যমন্ত্রী দুষ্যন্ত চৌতালা বলেছেন, তিন কৃষি আইন কৃষক-স্বার্থানুগ নয়। তাঁর দলের নয় বিধায়কের সমর্থনের উপর খত্তরের সরকারের অস্তিত্ব ও তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্ব্বের অস্তিত্ব নির্ভর করছে।

পাঞ্জাব ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদক সুখবীর প্রতিবাদীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে একটি উত্তর-সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছেন, “পাঞ্জাবের মাটিতে আলোকনপজাত অবশেষে হরিয়ানা এবং অন্যান্য প্রদেশেও সঞ্চারিত হয়েছে তার ফলে কৃষিক্ষেত্রে একটি ব্যাপকতর ফ্রন্ট গড়ে উঠেছে। পাঞ্জাবে এবার কৃষকদের রাস্তায় নেমে জাগরণের পিছনে আছে এ অঞ্চলে কৃষকদের সংগ্রামের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার সেই লড়াইগুলি এতদিন সুপ্ত থাকলেও পাঞ্জাবি ছেলেমেয়েদের এই  বিদ্রোহ-মেজাজ তাদের  সচেতন এবং অবচেতন মনে আজ জাগর। স্মরণ থাকতে পারে ১৯৭১ সালে বাথিন্ডা ও সাংরুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে ভারতের কমিউনিস্ট প্রার্থী হিশেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন কিংবদন্তীপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা তেজা সিং স্বতন্ত্র ও ভান সিং ভাওরা। আন্দোলনের নেতৃত্ব আশ্বাস দিয়েছেন (সুখবীরও লিখেছেন) এই আন্দোলনে জয়লাভ না অর্জন অবধি তাঁদের লড়াই জারি থাকবে। কিন্তু তারপরেও সংগ্রাম চলবে। তাঁরা নামবেন সিএএ আইন বাতিলের আন্দোলনে। কিন্তু আত্মসন্তুষ্টির জায়গা নেই। শহীদের তালিকা একশো ছাড়ালেও ফ্যাসিবাদী (অবশ্য সিপিআইএম নেতৃত্ব এখনও মানে না এ সরকার ফ্যাসিবাদী, বলেন ‘ফ্যাসিস্টিক’) মোদি সরকার এই কৃষকবিরোধী ও জনবিরোধী আইনগুলি প্রত্যাহার করে নেবে, এমন কথা ভাবার কোনও কারণ নেই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4644 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...