গ্লাসগো পরিবেশ বৈঠক: মূঢ়ত্বের স্কন্ধে ভবিষ্যতের বোঝা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

বিষয়টি বহুলচর্চিত। কিন্তু এমন কিছু প্রসঙ্গ রহিয়াছে যাহার পুনরুক্তি কদাচ দোষবহ নহে, বস্তুত সেসব কথা যত বেশি বলা যায় মানবজাতির ততই মঙ্গল। সারা পৃথিবীতে, এমনকী আমাদের চারপাশেও, এমন মানুষ এখনও প্রচুর, যাঁহারা বিশ্বাস করেন, এমনকী প্রকাশ্যে বলিয়াও থাকেন— পরিবেশ লইয়া কথোপকথন নিছক বাতুলতা মাত্র। আমাদের এই নীল গ্রহের জলবায়ু দ্রুত পালটাইতেছে, ঋতুচক্রের খামখেয়ালি আচরণ ও আবহাওয়ার পরিবর্তন ক্রমশ পরিদৃশ্যমান, জনজীবনে পরিবেশ-বিপর্যয়ের প্রভাব ক্রমবর্ধমান— কিন্তু এ-সকল দৃষ্টান্ত চোখে আঙুল দিয়া দেখাইলেও তাঁহারা পাত্তা দেন না, যাবতীয় সুপরামর্শ ফুৎকারে উড়াইয়া দেন। সারা পৃথিবী অভূতপূর্ব উষ্ণায়নের বিষময় প্রভাব প্রত্যক্ষ করিতেছে, মেরু-অঞ্চলের আবহমান-সঞ্চিত বরফভাণ্ডার দ্রুত হ্রাস পাইবার খবর প্রতিনিয়ত কানে আসিতেছে, বিশ্বব্যাপী জলভাগ উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়া একের পর এক সামুদ্রিক প্রজাতি ক্রমশ বিপদাপন্ন হইয়া পড়িতেছে— কিন্তু ঈদৃশ দৃষ্টান্তসমূহ তাঁহাদের বিচলিত করে না— বস্তুত এই ঘটনাসমূহ যে কার্যত অনতিভবিষ্যতের এক মহাবিপর্যয়ের ইঙ্গিত বহন করিয়া আনিতেছে, সে বিষয়েও তাঁহারা অবিচলচিত্ত, ভাবলেশবিবর্জিত থাকিতে পারেন।

আপনার ভবিষ্যতের নিরাপত্তার সুবন্দোবস্ত করা পৃথিবীর সকল প্রাণসত্তার এক প্রাথমিকতম কৃত্য— সরলমতি অ্যামিবা হইতে মহাধুরন্ধর মানবপ্রজাতি, কেহই এই প্রণোদনার ঊর্ধ্বে নহে। তথাপি, আমাদের মানবসংসারে এমন উদাহরণ কম নহে, যাঁহারা আপন মূঢ়তায় আপনার ভবিষ্যৎকেই ধ্বংস করিতে উদ্যত হন। এই আত্মঘাতী মূঢ়তা আমার-আপনার মতো জনসাধারণের মধ্যে পরিলক্ষিত হইলে তবু কিছু আশা বাঁচিয়া থাকিত। এক তো মানবসংসারে আমার-আপনার গুরুত্ব সফরীমৎস্যটির অপেক্ষা অধিক নহে— ফলতঃ আমার-আপনার নির্দেশ, ভয়ে-ভক্তিতে বা ভালবাসায়, মান্য করার মতো লোকের সংখ্যা কম; পরন্তু, আমাদের সেই ক্ষমতা নাই যে, আপন অবিমৃশ্যকারিতার কুফল বাকি বিশ্বকে জবরদস্তি ভোগ করাইতে পারি। আমি বড়জোর আমার বাগানের বহুপ্রাচীন কদম্বগাছটি কাটিয়া ফেলার সিদ্ধান্ত লইতে পারি; আপনি বড়জোর যথাসময়ে আপনার যন্ত্রবাহনটির পলিউশন সার্টিফিকেট সংগ্রহ না-করিয়া ধূম-উদ্‌গীরণকরতঃ আপনার সহনাগরিকদের বিরক্তি ও অস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করিতে পারেন। কিন্তু, যদি এই অবিমৃশ্যকারী মূঢ়তা গ্রাস করে ক্ষমতায় আসীন মানুষ বা মানববর্গকে, তাহার ফল যে কতদূর বিষময় হইতে পারে তাহার উদাহরণ জাইর বলসোনারো। সম্পূর্ণ একক কৃতিত্বে তিনি ব্রাজিলের আমাজন অববাহিকার সুবিস্তীর্ণ বর্ষণবন অত্যন্ত নিপুণহস্তে ধ্বংস করিয়া চলিয়াছেন। বলসোনারো কেবল এক ব্যক্তিমানুষের নাম নহে, বস্তুত এক্ষণে তাহা একটি মানবধ্বংসী বীক্ষার দৃষ্টান্ত— যাহা আশু অর্থনৈতিক মুনাফা অর্জন ও বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে শক্তিবিস্তারের লক্ষ্যে সারা বিশ্বের প্রকৃতি-পরিবেশ-ভবিষ্যৎকে এক ভয়াবহ পরিসমাপ্তির দিকে ঠেলিয়া দিতে একবারের বেশি দুইবার ভাবে না।

বস্তুত, মানবজাতির, কিংবা আরও সুনির্দিষ্ট করিয়া বলিতে গেলে, কতিপয় উন্নত ও বৃহৎশক্তিধর রাষ্ট্রের উদ্যোগে পরিবেশনিধনের যে সুপরিকল্পিত মহাযজ্ঞ চলিয়াছে, তাহা আত্মহত্যার অধিক— এ এক সামূহিক বিপর্যয়ের পথ প্রস্তুত করার সামিল। একদিকে যথেচ্ছ অরণ্য-ধ্বংস, অন্যদিকে ফসিল জ্বালানি পুড়াইয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসের অনিয়ন্ত্রিত নিঃসরণ— এই দুইপ্রকারে বিশ্বপরিবেশকে এক মহাবিপর্যয়ের প্রায় দ্বারপ্রান্তে পঁহুছাইয়া দেওয়া গিয়াছে। এমতাবস্থায়, গতমাসে গ্লাসগো-য় যে পরিবেশ-বৈঠক আয়োজিত হইয়াছিল, তাহার ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল কার্বন-নিঃসরণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলির ঐকমত্যের রাস্তা সন্ধান। বলা বাহুল্য, সে আলোচনায় নাটকীয় বাগ্‌বিস্তার ও বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়ার অধিক কিছু ঘটে নাই— অধিক কিছু ঘটিবে, তেমন প্রত্যাশাও অবশ্য ছিল না। এবং, প্যারিসের পর, সাম্প্রতিক গ্লাসগো বৈঠকের মঞ্চেও পুনরায় প্রমাণিত হইয়াছে— শক্তিধর রাষ্ট্রগুলি এখনও আপনাপন স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠিয়া সমগ্র মানবজাতির স্বার্থরক্ষায় আগ্রহী নহে। ফল যাহা দাঁড়াইয়াছে— কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করিয়া নেট-জিরো-র লক্ষ্যে যাত্রার প্রতিশ্রুতি কাগজে-কলমে খানিক গতিপ্রাপ্ত হইলেও, পরিবেশ-সংরক্ষণের মূল প্রশ্নগুলি বাহ্বাস্ফোট ও কূট বাগ্‌জালের আড়ালে উপেক্ষিতই রহিয়া গিয়াছে।

পরিবেশ লইয়া আমাদের জ্ঞান সীমিত, তবে কাণ্ডজ্ঞান কিঞ্চিৎ রহিয়াছে বই কী। সেই কাণ্ডজ্ঞানই আমাদের পরামর্শ দিয়াছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গ্লাসগো বৈঠকের নিষ্কর্ষগুলিকে পাশাপাশি রাখিয়া বিশ্ব পরিবেশ আন্দোলনের যাত্রাপথ ও ভবিষ্যতের রূপরেখাটিকে আরও একবার আনুপূর্বিক দেখিবার। সেই কাণ্ডজ্ঞান হইতেই চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই সংখ্যার প্রচ্ছদভাবনার পরিকল্পনা। আলোচনা করিয়াছেন সমর বাগচী, প্রদীপ দত্ত, সৌম্য দত্ত, সাগর ধাড়া এবং অংশুমান দাশ। এই গ্লাসগো পরিবেশ বৈঠকের প্রাক্কালে বিজ্ঞানী স্ট্যান কক্সকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়াছিলেন নোম চমস্কি। অতীব মূল্যবান বিধায় সেই সাক্ষাৎকারটির বঙ্গানুবাদও আমরা সামিল করিয়াছি এই রিজার্ভড বগিটিতে।

অন্যান্য বিভাগের মধ্যে এই সংখ্যায় আমরা স্মরণ করিলাম সদ্যোপ্রয়াত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে। তৎসহ কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, বিশেষ নিবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য, অন্যগদ্য, ফটোফিচার, অণুগল্প, ধারাবাহিক রচনা-র মতো নিয়মিত বিভাগগুলি রহিল যথাবিহিত। রহিল স্টিম ইঞ্জিন, ডিসট্যান্ট সিগনাল, হুইলার্স স্টল এবং ভালো খবর-এর ন্যায় বিশেষ বিভাগগুলিও।

পড়িবেন… এবং মতামত জানাইবেন অবশ্যই…

ভালো থাকিবেন…

 

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
অভীক ভট্টাচার্য

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

Leave a Reply to কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায় Cancel reply