অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
সাধুটার ঘরের পিছনে একটি বটবৃক্ষ রেখে গেছে কেউ। টবের ভেতর বট। উচ্চতায় প্রায় তিনফুট।
সাধুর ঘর প্রাচীন এক বটবৃক্ষের নিচে।
তার ঘর দেখে মনে হয়, সেটা নিজের হাতেই বানানো। অনিন্দ্য জানে না সাধুটি একে ঘর বলে না কুটির বলে। যাইহোক, তার ঘরের কথা এক্ষণে কিছু বলা প্রয়োজন।
ঘরটি ইটের। পাঁচ ইঞ্চির দেওয়াল। কোনও জানালা নেই। ইট দিয়েই একটি পুরো দেওয়াল জাফরি করা আছে।
নিচু হয়ে ঢুকতে হয়। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। একটা চৌকি আছে। কোন বিছানা নেই। পোশাক রাখার জন্য দড়ি টাঙানো। তাতে কিছু গেরুয়া বসন। ঘরের মাথায় টিন চাপানো।
ঘর নেমে গেছে নিচের দিকে। সেখানে একটা মাটির উনুন। সেখানটা এতটাই নিচু যে হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়াতে হয়।
সাধুটি এখানে একা থাকে।
তার ছেলেপুলে আছে।
তার সংসার বয়ে চেলেছে এই নদীর মতন।
ওর ছেলে আসে।
কথা কয়। চলে যায়।
আবার কোনওদিন সাধুটি চুপ করে থাকে।
ছেলেটি একাই বকে যায়।
এক এক দিন যখন সে সাধুকে কোথাও খুঁজে পায় না, অনিন্দ্যর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়।
নানা কথা বলে। নানা গল্প করে।
অনিন্দ্য বসে থাকে ওর ঘরের পিছনে।
সেখান থেকে পুরো নদী চোখের ভেতর ঢুকে যায়।
ঢেউ-জলস্রোত-প্রবাহ-নৌকা—।
নদী চলেছে সেখানে যেখানে তার শান্তি মেলে।
তারপর এই বর্ষাকালটা এসে গেল।
গঙ্গার জল ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘাটের শেষ ধাপ।
জল ছুঁয়ে যাচ্ছে নিচু পাড়।
সাধুর কুটির উঁচু পাড়ের একদম কিনারে।
জল এড়িয়ে যায় তার কুটির।
জল বাড়লে নৌকা দোলে। নৌকাটা বাঁধা থাকে নিচু পাড়ের নিচের জলে।
সাধুটা সব সময় যে নদীর ধারে বসে থাকে চুপ করে, তা নয়। সে নদী বরাবর হেঁটে যায়। ওর কোনও ভক্ত নেই, কোনও শিষ্য নেই। ওর কী করে চলে, সেটা জানে না অনিন্দ্য।
সাধুর সঙ্গে কোনওদিন অনিন্দ্যর কোন কথা হয়নি।
অনিন্দ্য জানে, সাধু অযোধ্যাফেরত। ওখানে ছিল টানা দশবছর। ফিরে এসেছে তিনবছর আগে।
অযোধ্যায় একবার সাধুকে এক হনুমানে কামড়ে দিয়েছিল।
ছেলে বলে, ফিরে চলো বাবা।
বাবা কিছু বলে না। কেবল মন্দিরের চাতালে বসে মৃদু হাসে।
ছেলে চলে যায়।
অনিন্দ্য উঠে পড়ে। ফিরবে। তার আগে একবার সে নদীর দিকে ফেরে। নদীতে দুই হাত জোড় করে প্রণাম করে।
সাধুর বাড়ি এখান থেকে কিমি দুয়েক দূরে। সাধারণ পরিবার। সাধু আগে জুটমিলের শ্রমিক ছিল। পরে বৈরাগ্য আসে। ছেলেরা তখন সবে কলেজে ঢুকেছে। সাধু চলে যায় রামভূমিতে। ওখানের একটি গোষ্ঠীতে ছিল সাধু। কপালে চওড়া করে সাদা ও লাল রঙের ছাপ, লম্বালম্বি করে টানা। সাদা ধুতি আর চওড়া পাড় পরত তখন। ছেলে কোনওদিন অযোধ্যা যায়নি। ইচ্ছে নেই।
সাধুর ছেলের মাথায় নিয়মিত ছাঁটা চুল। তাতে লম্বা টিকি গিঁটবাঁধা। পরনে ধুতি আর পাঞ্জাবি। সে আসে সাইকেলে।
ফিরে এসে একদিনই ঘরে গেছিল সাধু। ভেতরে যায়নি। ফিরে এসে গঙ্গার পাড়ে জায়গা খুঁজে নিয়ে এই ঘর বানায়।
ফিরে এল কেন?
ওখানে শান্তি পায়নি।
কীরকম?
দশবছর থেকেও যে মনশান্তির খোঁজ বাবা করছিল, পায়নি। যেমন হয়, প্রথম প্রথম ভাল লেগেছিল। পরে একঘেঁয়ে হয়ে গেল। ওদিকে প্রচুর বাঁদর। সেটাও ক্রমে ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠতে থাকে। একদিন কপালে আঁচড়ে দেয়। বাবা ট্রিটমেন্ট কিছু নেয় না। ছয় বছর হয়ে গেল। এখন সেই জায়গা থেকে ছাল ওঠে।
এখানে শান্তি কোথায়?
বাবা জানে।
অযোধ্যার মতো জায়গা ছেড়ে চলে এল!
যে বর্ষাকালটা এসেছিল, সেটা এখন ফুলদমে চলছে। টবের বটের পাশে আরও একটা বটবৃক্ষ যুক্ত হল। এবারেরটা একটু ছোট। কিন্তু সেই টবে।
এল গঙ্গামাতার সুদৃশ্য মূর্তি। সঙ্গে এল মৃতপ্রায় কোমরভাঙা একটি আমগাছ।
মূর্তিটি আসলে কার— সেই নিয়ে কলেজের ছেলেদের তর্ক বেঁধে যায়। কেউ বলে ভারতমাতার, কেউ বলে গঙ্গামাতার। সাধু তার মাথার উপর একটা ছাউনি করে দেয়।
সাধু কী করবে এ সব নিয়ে?
সাধু বিড়ি খায়।
মধ্যে মধ্যে উদাস হয়ে বিড়বিড় করে।
সাধু গাঁজা টানে।
গঙ্গা দেখে।
জল বয়ে যায়…
নৌকা যাচ্ছে…
নদী যায়…
পাখিরা তার কোলের উপর দিয়েই হেঁটে বেড়ায়।
গরমের সময় তার হাতে টুপুটুপ করে জামফল পড়তে দেখেছে সে।
নিচু পাড়ে গায়ে গায়ে বেড়ে উঠেছে কিছু গাছ। জাম-আম-লিচু-পেয়ারা-সবেদা। জবা ও টগর। নিচেটায় কখনও রোদ ঢোকে না। তাদের গুঁড়ি ঘরে নানা পাথর উপর উপর সাজিয়ে বেদি বানানো। গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা নানা আকারের শিবপাথর।
সাধুটাই পুজো করে।
তাও রোজ নয়।
সাধুর খেয়াল।
চারপাশের নানা গাছে প্রচুর কাঠবেড়ালির বাস। তারা অনায়াসে যাতায়াত করে সাধুর কুটিরেও।
তাদের বাচ্চারা সাধুর ঘরের চালে পড়ে থাকা লাল বটফল কুটকুট করে খায়।
একদিন সাধু ছেলেকে বলে, গাছগুলি নিয়ে যা।
কী করব?
বাইরে ভিতরে বসাবি।
এদিকে গাছ বেড়ে হয়ে যায় তিনখানা। এবারে আসে জবাগাছ।
কারা রাখে? কেন?
সাধু উত্তর করে না।
ক্রমে ক্রমে বর্ষার তাড়ায় শিকড় চারিয়ে বট টব ফাটিয়ে ফেলে। কাত হয়ে যায়। সাধু কয়টি ইঁট কুড়িয়ে তাকে সোজা করে দেয়।
আবার বর্ষাকাল এসে যায়।
এরপর বৃষ্টি আর বৃষ্টি।
টানা তিনিদিন।
অফিস ফেরত রুমাল মাথায় দাঁড়ায় অনিন্দ্য।
গাছেদের নিচে বৃষ্টি আসে কম।
গাছ ভেজে, পাতা ভেজে, মানুষ ভেজে না।
এদিকে নদী ভিজে যায় বৃষ্টিতে।
নৌকা ভিজে ভিজে সিক্ত হয়ে ওঠে।
সারাক্ষণের বৃষ্টিতে আকাশেরও কেমন যেন ভিজে ভিজে ভাব।
হু হু করে বাড়ছে বটবৃক্ষ ও ফল-ফুলের গাছেরা।
এপার ওপাড় কেবল বৃষ্টির ধোঁয়া।
সাধু ডাকল একদিন।
আয়।
অনিন্দ্য গেল।
সাধু নিজেই কথা বলে, দুই দশ মিনিটের জন্য রোজ গঙ্গামাতাকে দেখলে মনে শান্তি আসবে না। শান্তি পেতে গেলে গঙ্গা মাঈয়ার নিয়মিত স্তব করতে হয়। ঐ যে নতুন বটবৃক্ষে নতুন উপবন সৃষ্টি হয়েছে, ওখানে পাথরের আসন বানিয়ে দিয়েছি। যা গিয়ে ধ্যানে বোস।
তারপর একদিন অনিন্দ্য কুটির বানায়।
ক্রমে ক্রমে নৌকাও।
পরের বর্ষার কাঁচা জলে সাধুকে সে জলভ্রমণ করায়।
লোকে বলে, যাক, অযোধ্যা ফেরত সাধু এদ্দিনে একটা চেলা পেয়েছে।
আর অনিন্দ্য ভাবে, একদিন তারও গায় পাখিরা বসবে।
সেও গাছের নিচে বসে হাত পাতলে গাছেরা তাদের পাকা ফল টুপটাপ করে ঝড়িয়ে দেবে।
হয়ত পরের বর্ষায়…
বা তারও পরের…
হয়ত বা…