ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ২০০: চতুর্থ বর্ষ, সপ্তম যাত্রা

স্টেশন মাস্টার

 

 

এই শতাব্দীর প্রারম্ভকালে এক প্রবীণ কমিউনিস্ট কর্মীর সহিত কিছু আলাপচারিতার সুযোগ হইয়াছিল। আপনার প্রায় তিনদশক ব্যাপ্ত রাজনৈতিক জীবন ছানবিন করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন— ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সঙ্কট, তাঁহার উপলব্ধিতে, পাতিবুর্জোয়াসুলভ আত্মসর্বস্বতা। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যাঁহারা আসীন হইয়াছেন, শ্রেণি-উৎস বিচারে তাঁহাদের অধিকাংশই ঐতিহাসিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি হইতে আগত। ইহার পশ্চাতে কিছু সামাজিক বাধ্যবাধকতাও বর্তমান বইকী। কিন্তু তাহা সমস্যা নহে, সমস্যা হইল, জীবনচর্যায় প্রকৃত কমিউনিস্ট হইয়া উঠিতে গেলে আপন শ্রেণি-চারিত্রের বিরুদ্ধে যে নিরন্তর সংগ্রাম চালাইয়া যাওয়া প্রয়োজন, তাহার অভাব। অভাব চারিত্রিক দার্ঢ্য ও আত্মবীক্ষারও। সেইখানে ফাঁকি চলে না। যতদিন সেই সংগ্রাম চলিবে, ততদিনই শ্রেণি-রূপান্তরের প্রক্রিয়া ক্রিয়াশীল থাকিবে; যখনই তাহাতে ফাঁকি পড়িবে, শুরু হইবে বিপরীত প্রক্রিয়া। ইহাই দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্ব। আর মার্কসবাদী মানদণ্ডে মধ্যবিত্তশ্রেণির সর্বাপেক্ষা নেতিবাচক চারিত্রই হইল তাহার অহং। এই প্রসঙ্গে নকশালপন্থীদের উদাহরণ দিয়াছিলেন ভদ্রলোক। বলিয়াছিলেন, এই যে চারু মজুমদার শহীদ হইবার পর পলক না পড়িতেই আমরা দেখিলাম বৃদ্ধার মুখের বলিরেখার ন্যায় শতধাবিভক্ত হইয়া গেল সিপিআই (এম-এল), কী ব্যাখ্যা ইহার? ইহাতেই কি স্পষ্ট হয় না যে, যে নেতৃবৃন্দ চারু মজুমদারের জীবৎকালে তাঁহার নামে জয়ধ্বনি না-দিয়া জলস্পর্শ করিতেন না, আসলে তাঁহারা কেহই মন থেকে তাঁহার নেতৃত্ব মানিয়া লইতে পারেন নাই? একমাত্র সরোজ দত্ত ব্যতিক্রম। রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে দেখিলে, কেবল এই দুইজনকেই যে চিরতরে মুছিয়া ফেলা প্রয়োজন হইয়াছিল, তাহা কিন্তু নিতান্ত আপতিক নহে। মুছিয়া ফেলা হইয়াছিল, না-মুছিয়া উপায় ছিল না বলিয়াই!

ভাবিবার মতো কথা, সন্দেহ নাই। আগ্রহীজনেরা ভাবিবেনও। বিষয়টি স্মরণে আসিল মেল ট্রেনের এই যাত্রায় আমাদের রিজার্ভড বগির প্রসঙ্গে। এই বৎসর ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের দ্বিশতবর্ষে পদার্পণ। আগামী ২৮ নভেম্বর কার্ল মার্কসের এই ঘনিষ্ঠতম সহযোদ্ধা দুই শত বৎসরে পদার্পণ করিবেন।

আপন ভূমিকাকে এঙ্গেলস বলিতেন ‘দোহারের ভূমিকা’। কী আশ্চর্য এই দোহার এবং তাঁহার দোহারকি! সেই ১৮৪৪ সনে তিনি যখন ‘ইংলন্ডে শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা’ বিষয়ে সন্দর্ভ লিখিতেছেন— যে পুস্তক পরবর্তী কালে অবলীলায় স্থান করিয়া লইবে মার্কসবাদী ক্লাসিকগুলির মধ্যে— তখনও কার্ল মার্কসের সহিত তাঁহার ভাল করিয়া পরিচয় হয় নাই! এই দোহার তাহার পরে লিখিবেন ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’— বিদগ্ধজনের মতে যে গ্রন্থ সম্যক আত্মস্থ করিতে পারিলেই মার্কসবাদ সম্পর্কে প্রভূত জ্ঞানলাভ সম্ভব; লিখিবেন ‘প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’— যাহার মাধ্যমে মার্কসবাদী দর্শন এবং প্রকৃতিবিজ্ঞান সমন্বিত হইবে চিরতরে; লিখিবেন ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’— লিঙ্গবৈষম্যের ঐতিহাসিক ভিত্তি সম্পর্কে সুস্পষ্ট উপলব্ধিতে উপনীত হওয়া যাইবে যাহার মাধ্যমে!

অর্থাৎ মার্কসবাদকে সমাজ ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমন্বিত ও সম্পৃক্ত করা শুধু নহে, প্রোথিত করার কাজটিও সারাজীবন ধরিয়া করিয়া গিয়াছেন এই দোহার, নির্বিকার চিত্তে! পরবর্তীতে যাঁহারা মার্কসবাদ সম্পর্কে কিছুমাত্র জানাশোনার অধিকারী হইবেন, তাঁহাদের মধ্যে নিতান্ত বুর্জোয়াশ্রেণির কলিকায় তাম্রকূটসেবীরা ছাড়া প্রত্যেকে স্বীকার করিবেন— ইহা হইতেও পারিত এঙ্গেলসবাদ। আশ্চর্য কী, মার্কস বরাবরই অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাবনত থাকিবেন তাঁহার এই আশ্চর্য সহযোদ্ধা সম্পর্কে!

আর আজ এই দুই শতাব্দীর পার হইতে বিস্ময়াভিভূত চক্ষে আমরা সেই মহান জীবনের কথা স্মরণ করিয়া মনে মনে ভাবিব— ভাগ্যিস, এঙ্গেলস ইগো-তাড়িত হন নাই!

ভারতবর্ষ, তথা আজকের পৃথিবী লইয়া আলোচনা হইতেছে লাগাতার। আমরা, এই চার নম্বর প্ল্যাটফর্মেও করিতেছি, হইতেছে অন্যান্য নানা স্থলেই। এক্ষণে তাহা লইয়া বাকবিস্তারের প্রয়োজন নাই, কিন্তু একটি কথা প্রাসঙ্গিক— আমরা ক্রমশই আপন আপন জীবন দিয়া উপলব্ধি করিতে শুরু করিয়াছি যে, যাহাদের আমরা অতি-দক্ষিণপন্থী, উগ্র-ডান ইত্যাদি বলিয়া অভিহিত করিতেছিলাম, সারা বিশ্ব জুড়েই সেই শাসকরা বর্তমানে নিজেদের উন্নত করিয়া ফ্যাসিবাদে উপনীত হইয়াছে। আর ইতিহাস আমাদের শিখাইয়াছে ফ্যাসিবাদের মোক্ষম দাওয়াই একমাত্র সমাজতন্ত্র— মার্কসবাদ— কমিউনিস্টরা। অতএব, আজিকার পৃথিবী কমিউনিস্টদের মুখাপেক্ষী— সম্ভবত অতীতের যে কোনও সময়ের চাইতেও বেশি ব্যাকুলতায়। আর, অন্তত ভারতবর্ষে বোধহয় আমরা বলিতেই পারি, কমিউনিস্টদের আজ ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ন্যায় দোহারের বড় প্রয়োজন।

এঙ্গেলসের দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন তাই আজ সময়ের দাবি।

এই প্রসঙ্গে বলিয়া রাখি, গত জুন মাসে আমরা যখন লেনিনের জন্ম-সার্ধশতবর্ষ উদযাপন করিয়াছিলাম, তখনই স্টেশনমাস্টারের কেবিনে সিদ্ধান্ত হইয়াছিল যে, নভেম্বরে আমরা এঙ্গেলসে জন্ম-দ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন করিব। উল্লেখ্য, চারনম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলীতে এহেন ঐকমত্য এবং অগ্রিম বিষয়নির্বাচনের সিদ্ধান্ত বিরল।

আমাদের এই রিজার্ভড বগি ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ২০০-তে এঙ্গেলস সম্পর্কে নানা দিক দিয়া আলোচনা করিলেন কণিষ্ক চৌধুরী, কুণাল চট্টোপাধ্যায়, কুন্তল ঘোষ ও শঙ্খশুভ্র নাগ, সোমা মারিক, সুশোভন ধর, প্রতীপ নাগ এবং প্রবুদ্ধ ঘোষ

অন্যান্য বিভাগের কথায়, স্মরণ বিভাগে সদ্যোপ্রয়াত প্রখ্যাত অভিনেতা শন কনারির সহিত জন্ম-সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে স্মরণ করা হইল বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। রহিল গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, অণুগল্প, অন্যগদ্য, অনুবাদ সাহিত্য, ফটোফিচার ও ধারাবাহিক উপন্যাস ও রচনাগুলির ন্যায় মেল ট্রেনের নিয়মিত বিভাগগুলি। স্টিম ইঞ্জিন, বিশেষ নিবন্ধ, সবুজ স্লিপার, ডিসট্যান্ট সিগনাল, হুইলার্স স্টল এবং ভালো খবর-এর ন্যায় বিশেষ বিভাগগুলিও থাকিল যথারীতি।

পড়ুন, অবশ্যই মতামত দিন, ভালো থাকুন।

এঙ্গেলস আমাদের হৃদয়ে চিরজীবী হোন!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. ভালো লেখা। দুটো বিষয় বলি – (১) খানিকটা ব্যক্তিগত স্তরে চলে গেছে লেখাটি , নৈর্ব্যক্তিক হবার পরিবর্তে, (২) আমার বিচারে ইউরো-আমেরিকান রাষ্ট্র যেভাবে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে পারে, ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রে সেটা অতিরাষ্ট্র হয়ে ওঠা।

Leave a Reply to Anonymous Cancel reply