অ-স্বতন্ত্র সম্পর্কের বিচ্ছুরণ

অ-স্বতন্ত্র সম্পর্কের বিচ্ছুরণ : রুখসানা কাজল

রুখসানা কাজল

 

দিনরাত একাকার হয়ে যাচ্ছে। জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে সময়। ঘড়ির বুকের খাঁচায় ঘন্টা মিনিট সেকেন্ডের কাঁটাগুলো একগুঁয়ের মত ঠুসে গেঁথে আছে। প্রায় অচল। এগুচ্ছে কি! মনে হয় না। রুগ্ন নিথর আর সন্ত্রস্ত সময়ের উদ্বাহু যাপন চলছে পৃথিবীতে।

কিন্তু আর কতদিন! আর কবে এ বনসাই সময়ের কাল কাটবে? পৃথিবী আবার চঞ্চল হয়ে উঠবে বাড়ন্ত কিশোরের কৌতূহল নিয়ে!

লুনা ধারণা করে নিয়েছিল শীতের রূঢ়তা, গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষার ধারাজলে স্নাত হয়ে রুগ্ন পৃথিবী আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। চেনা ছন্দের পৃথিবীকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে তারা নতুন উদ্যমে ছুটে যাবে প্রকৃতির কাছে। কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসায় হাত রাখবে সতত ক্ষমাশীল ধরিত্রীর বুকে।

আদতে তার কিছুই হচ্ছে না। দু-একমাস চুপ থেকে তেড়েফুঁড়ে আসছে কোভিড বাবাজির নতুন নতুন ঢেউ। তাতে বেশুমার মানুষ রুগ্ন হচ্ছে। মৃত্যুহারও বেড়ে যাচ্ছে মানুষের ধারণার বাইরে। বিজ্ঞানীদের থোঁতা মুখ ভেচরে ভোঁতা হয়ে গেছে। সব প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট এসে নাজেহাল করে দিচ্ছে তাঁদের। দেশে দেশে রাষ্ট্রনায়করাও দিশেহারা। পারলে লৌহবর্ম দিয়ে ঘিরে রাখত নিজ নিজ রাষ্ট্র। কিন্তু সে তো সম্ভব নয়!

এরকম অসুখের মধ্যেই সাজনিন চলে গেল আমেরিকা। মৃদু আপত্তি করায় মেয়ে বিরক্ত হয়ে বলেছিল, মা কেবল তোমার মেয়েকে নিয়ে প্লেন যাচ্ছে না। আরও মানুষ যাচ্ছে। পৃথিবীকে নিয়ে একটু ভাবতে শেখো।

মোবাইলে সময় দেখে লুনা। রাত তিনটা বেজে দশ মিনিট। বারান্দায় শখ করে একটা বেতের দোলনা ঝুলিয়েছিল সাজনিন। সারাক্ষণ ঝুলে ঝুলে মোবাইল করত। আমেরিকা যাওয়ার আগের রাতেও ওখানে বসে আসিফের সঙ্গে কথা বলেছিল। বারান্দালাগোয়া রুমে কাপড় ভাঁজ করতে করতে আঁতকে উঠেছিল লুনা। কী ধুরন্ধর হয়ে উঠেছে তার মেয়ে! কত অনায়াসে বলে যাচ্ছে, মিস ইউ আসিফ। তোমাকে খুব মিস করব। নেক্সট ইয়ারে তুমি কিন্তু চলে আসবে। প্রমিজ? লাভ ইয়ু বেবস। টেক কেয়ার।

আসিফকে বিয়ে করবে বলে জানিয়েছিল সাজনিন। সন্দ হচ্ছে এখন। আসলে কী করবে! খানিক আগেই রূপনের সঙ্গে কথা পাকা করেছে লুনা। ওর কাছে গিয়ে উঠবে। ভালো লাগলে ওর সঙ্গেই থেকে যাবে। রূপনের ডিভোর্স হয়ে গেছে ওর মেক্সিকান বউয়ের সঙ্গে। বাচ্চার খোরপোষসহ আদ্ধেক খরচ রূপনকে দিতে হয়। ইনফ্যাক্ট আমেরিকান নিয়মে এটা দিতেই হবে। চোখ সরু করে ফর্কে চিকেন টুকরোটাকে বাগে এনে সাজনিন লুনাকে বলেছিল, ওদের ডিভোর্সের নিয়ম বাংলাদেশের মত না। সব সমান সমান। ডিভোর্সের পর বাচ্চারা বাবামা দুজনের কাছে আসবে যাবে। ঘুরবে ফিরবে। নতুন বাবা বা মা হলে তাদের সঙ্গেও থাকবে, যাবে। খালামনি যেমন আয়মনকে নিয়ে আত্মীয়স্বজন থেকে পালিয়ে পালিয়ে থেকেছে সেরম না। ওদেশে মানুষের মূল্য আছে।

রূপনের সঙ্গে থাকবে শুনে লুনার ভালো লাগছিল না। একবার শুধু বলেছিল, অফিসের কাজেই তো যাচ্ছিস। একাও তো থাকতে পারিস। মাঝে মাঝে আমরাও ঘুরতে যেতাম!

খ্যাচ করে উঠেছিল মেয়ে, সে দেখা যাবেনে। সব কিছুতে জাজমেন্ট দিও না তো মা। ভাল্লাগে না।

লুনা আর কিছুই বলেনি। ডিজিটাল মা হয়ে লুনার পেছনে তাকানো চলবে না। থাই গ্লাসের জানালা হয়ে থাকতে হবে। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে যাওয়া। না দেখতে চাইলে সময় সময় পর্দা টেনে দাও। ব্যস ফুইরে গেল তোমাদের গার্জেনশিপ। আর মাতৃত্ব পিতৃত্ব? ওটা রাখতে হবে আধপাকা কলার মত। দেখতে শক্ত ভেতরটা নরম।

বছর কয়েক আগে ডান ব্রেস্টের ঠিক উপরে আজগুবি এক ট্যাটু এঁকে এসেছিল সাজনিন। ট্যাটুরও নাকি অর্থ থাকে। এ ট্যাটুর অর্থ হচ্ছে, খোল যা সিম্‌সিম। তাই শুনে আব্বাস ফ্যা ফ্যা করে হেসেছিল। যেন তার মেয়ে বিশ্বের অনুদ্ঘাটিত সব রহস্য খুলে ফেলেছে। বিশ্রী লেগেছিল লুনার। প্রচুর ডিসগাটিং ট্যাটু। অশ্লীল কদর্য অর্থ। লুনা তবু আধপাকা কলা হয়ে চুপ মেরে গেছিল। নইলে মেয়ে বলে বসবে, ফাক য়ুর সোসাইটি মা্ম। ফাক য়ুর আইডোলজি। অসুবিধে হলে বলো চলে যাই বাসা থেকে।

তা চলে যেতে পারে সাজনিন। ওর বন্ধুদের অনেকেই চাকরি পেয়ে নিজেদের বাসা ছেড়ে আলাদা থাকছে। বাসায় থাকলে বিড়ি সিগ্রেট গাঁজাফাজা মদমুদ খাওয়ার বেজায় অসুবিধা। গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডদের নিয়ে ডোর লক করলে ভূমিকম্প হয়ে যায়! তাছাড়া দুদিনের উইকলি ছুটির মৌজমস্তি শেষে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমানো যায় না। সকাল হলেই লাগাতার নক করে করে দরজা প্রায় ভেঙে ফেলে মায়েরা চেঁচায়, কই রে ওঠ, নাস্তা করতে আয়— ওরে এবার ওঠ— উঠে পড়— শরীর খারাপ করবে যে!

ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রপাত ভুলুণ্ঠন। এই সব মায়েরা জরায়ুর স্বাধীনতা চায় অথচ সন্তানের ব্যক্তিস্বাধীনতার কচু বোঝে।

পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে এক বিকেলে কফির উপর ক্রিম ঢেলে সাজনিন বলেছিল, মা তোমরা কি ভাবো জন্ম দিয়েছ বলেই আমরা তোমাদের ক্রীতদাস? ওঠাবসা পড়া খাওয়া ঘুম সব কিছুতে কৈফিয়ত দিতে হবে বা তোমাদের নিয়মে চলতে হবে! আমরা যদি এতই খারাপ হই তো অফিসে এত এত কাজ কি করে করি? একটু বোঝা মা, উই হেইট দিস প্যারেন্টিং!

সেদিন লুনাও মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিল। কড়া করে বলেছিল, ইচ্ছে করলে তুমি আলাদা বাসা নিতে পারো সাজি। বাবা মা হয়ে আমরাও এমন কিছু অপরাধ করে বসিনি। তাছাড়া তোমার টাকায় আমরা খেয়েপরে বাঁচি না তুমিও এটা জেনে রাখো।

সাজনিন ক্রিম মাখা ঠোঁটে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলেছিল, হেই বাডি শেইম টু মি। আমিও আমার টাকায় চলি ফিরি খাই। আমারও আলাদা থাকার গাট্‌স আছে। এটুকু বুঝলে খুশি হব মা…

সেদিন গুম মেরে গেছিল লুনা।

এরপর বাবামাদের নিয়ে নানারকমের মজার মজার ভিডিও পাঠিয়ে সাজনিনই নর্মাল করে নিয়েছিল পরিবেশ। লুনা বোঝে বাবামা হিসেবে ওরা আধুনিক কিন্তু সে অর্থে এ যুগের টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। ওরা যেমন বরাবর জেনে এসেছে, সকালে নাস্তা না করে একবারে ব্রাঞ্চ করলে শরীর ক্ষয়ে যায়! মদ খেলেই মাতাল হয়। গাঁজা খেলে সবাই গাঁজাখোর বলে ক্ষেপায়। অথচ পৃথিবীর বহু দেশে গাঁজা এখন আইনত সিদ্ধ। ওপেনলি বিক্রি হচ্ছে। নেট ঘেঁটে এগুলো লুনাকে সেন্ড করে সাজনিন লিখে জানায়, বুদ্ধিটা খানিক বাড়াও মা। সারাক্ষণ ফেসবুক আর ফেসপ্রেম না করে গুগল দেখো। সার্চ দাও। পড়ো। জানো। নিজেকে আপ টু ডেট কর হে বালিকা!

লুনা খাবি খেতে খেতে দেখে আর ভাবে, অহো স্বাধীনতা। তোমার কতশত রঙিলা পাখনা গো! কোথায় ছিলে আমাদের সময়ে! চারুকলার বন্ধ্যা পুকুরের তলে বন্ধুদের সঙ্গে একবার সিগ্রেট টেনেছিল লুনা। সে খবর কী করে যেন পৌঁছে গেছিল বাসায়। ঘরে ফিরতেই মা রেগেমেগে জুতিয়ে লম্বা দাগ করে দিয়েছিল ওর পিঠে।

সাজনিন দেশে থাকতে কালেভদ্রে দোলনায় এসে বসেছে লুনা। চলে যাওয়ার পর দোলনাটা একা একাই দুলে যেত বাতাসে। মলিন হয়ে গেছিল গদির কভার। দুনুর মা ঘর মুছতে এসে আহহা করে দুঃখ করত। আন্তরিক দুঃখ। এটা ঠিক, সাজনিন কখনও গৃহকর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত না। লুনার কি কখনও মায়া লাগত শূন্য দোলনা দেখে?

না ঠিক সেভাবে লাগত না। মেয়েকে নিয়ে চরম দুশ্চিন্তা ছিল ওর। একা শুধু ওর মেয়েকে নিয়ে যে তা নয়। সাজনিনের গোটা বন্ধুদল নিয়েই ও অবাক হয়ে যেত। এ কেমন বন্ধুতা ওদের! ছজন ছেলেমেয়ে ছজনই একে অ্ন্যের সঙ্গে সর্বতোভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ! শারীরিক শুচিতার বিন্দুমাত্র ছুঁকছুকানি নেই কারও। ছজন ছজনের সঙ্গেই শারীরিক সুতায় বাঁধা!

খাওয়া পরা শোওয়া থেকে অফিস বাইরে ঘোরাঘুরি কোনও কিছুতেই ওদের কারও উপর কোনও কর্তৃত্ব, দায়ভার বা জেলাসি ছিল না। সে তো ভালো কথা। কিন্তু এই ফিজিক্যাল রিলেশনের ক্ষেত্রে কি সমানভাবে সবার সঙ্গে একভাবে হয়? হলেও সে বন্ধুত্ব কি টিঁকে থাকে?

–টিঁকে যে থাকে সে তো ফাতেমা আর নূরকে দেখেই বুঝতে পারছ মা। বিয়ে করে দিব্যি আছে। আর দেখছ তো ওরা কত হ্যাপি।
–কোনও সন্দেহ জাগে না?

লিপ পাউট করে সাজনিন, পার্টনার চুজ করা পার্সোলাল ম্যাটার মাম। ফাতেমা চাইলেই আসিফ বা নূরের সঙ্গে— নূরের ইচ্ছা হলে আমাদের সঙ্গে— তুমি খাবি খাচ্ছ কারণ ইয়ু হ্যাভ নো চয়েস। অই যে কী যেন বলে না, থোড় বড়ি টড়ি জাতীয় কী যেন— বাবা আর তুমি বিশ্বাস করো, গত জন্মে তোমরা হংসমিথুন ছিলে, এজন্মে লুনাব্বাস হয়েছ, সামনের জন্মেও—

হেসে ফেলে লুনা। বলিউডের সিনে সাংবাদিকদের মত আব্বাস আর ওর নামকে নিয়ে লুনাব্বাস বলায় মজা পায়। মেয়ের তো সবকিছুই ঠিক আছে। পড়াশুনায় বরাবর ব্রিলিয়ান্ট ছিল। চাকরিবাকরি, বন্ধুবান্ধব, এমনকি মাসের বেতন পেলে অনেকগুলো টাকা লুনার হাতে দিয়ে ভারিক্কি একটা হাসি দিয়ে রুমে ঢুকে যায়। তবে কেন ও অযথা ভেবে মরে! আব্বাস তাহলে ঠিকই বলে। লুনা ছিদ্রান্বেষী! আরে ভাই ছেড়ে দাও না। ওদের জীবন ওরা অনেক ভালো বোঝে। তুমি ক্যানে খেতা পুড়াও!

হয়তো বোঝে কিন্তু লুনা যে ওদের ভালো করে বুঝতে পারে না! বোঝা না-বোঝার ট্রমায় আটকে ছটফট করে। চলে গিয়ে ভালো করেছে সাজনিন। অন্তত চোখের আড়ালে যা করে করুক, দেখতে তো হচ্ছে না!

লুনার দু বছরের বড় বোন বুলা ডাক্তার। একটি ছেলেবাচ্চা নিয়ে ডিভোর্সি। ছেলে আয়মানও ডাক্তার হয়েছে। কিন্তু পেশাদারিত্ব বলে কিছু নেই। ইচ্ছে হলে চেম্বারে আসে। আবার সব ছেড়ে কিছুদিনের জন্যে বন বাদাড় পাহাড় জঙ্গলে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বিয়েতে আগ্রহ নেই। তবে চমৎকার একটি মেয়ের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে। সে মেয়েও পঙ্খীরানি। হাফপ্যান্টের সঙ্গে গেঞ্জি কামিজ হাতের কাছে আয়মানের শার্ট-ফাট যা পায় তাই পরে আয়মানের সঙ্গে সমানতালে পাহাড় পর্বত নদী জনপদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছবি তুলছে। পোস্টাচ্ছে। কমেন্টে যাচ্ছেতাই গালি খেয়েও আরও বেশি করে ছবি পোস্ট করছে।

হাসপাতালের ক্যান্টিনে লুনাকে নিয়ে কফি খাচ্ছিল বুলা। তোর খারাপ লাগে না বুলাপ্পি?

–না, লাগে না। ওরা সামলাতে পারলে আমাদের কী! তাছাড়া ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে মাবাবার গুরুত্ব কমে যায়। ইনফ্যাক্ট নিজেদেরই কমিয়ে ফেলতে হয়।
–আমার যে ভয় লাগে। ওরা কি নর্মাল তুইই বল! আমার মেয়েটা— আচ্ছা নামাজ রোজা শেখাইনি বলে কি মেয়েটা এমন হল?
–মাদ্রাসার খবর জানিস? হুজুরদের কায়কারবার কি অজানা তোর? হুজুররাও তোর চে দশ পা আগিয়ে আছে গাধা। আল্লামা মামুনুল হকের কথা ভুলে গেলি!

কফি হাতে ভাবনায় ডুবে থাকা ছোটবোনকে দেখে বুলা সান্ত্বনা দেয়,

–তুই একটু বেশি ভাবিস। ছেড়ে দে না লু! ওদের জীবন ওদেরকেই না হয় বুঝে নিতে দে।

লুনা ছেড়ে দিতে গিয়েও পারে না। বুকের ভেতর ভয় ঢুকে গেছে। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা পলিগামাস হল! শুধু কি তার মেয়ে? কী হচ্ছে চারদিকে! তারা স্বামীস্ত্রী তো— মাথাটা নুয়ে আসে লুনার। না সে আর আব্বাস কেউই পিওর মনোগোমাস নয়। তাই বলে এমন বারোয়ারি শরীরবিলাস! সেও সর্বসম্মতভাবে!

আজকাল দোলনায় এসে বসে থাকে লুনা। আব্বাস ফেসবুকে বরাবরই অ্যাক্টিভ। আটষট্টির পুরুষ হয়েও বয়সে ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খুবই বন্ধুবৎসল। বুকের ছাতি খুলে হাসে। না দেখা বন্ধুদের সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলে যেন আব্বাসের কতকালের চেনা! মাঝে মাঝে লং ড্রাইভ বা শর্ট ডেটিং-এ চলে যায়। স্থুল পেট, চুপসানো বেলুনের মতো ঝুলন্ত গাল, টাকমাথার আব্বাসের সঙ্গে দিব্যি ডেটিং করছে মেয়েরা। লুনা পারে না। কয়েকবার খুব গোপনে একেবারে নিশ্ছিদ্র অজ্ঞাতে সাহসী হতে পারলেও অসংখ্যা দ্বিধা, সঙ্কোচ, পাপপূণ্যের ভয় আর শুচি-অশুচিতার কনসেপ্ট ওকে ছেঁকে ধরেছে। ফেসবুকে লুনাও অ্যাক্টিভ। নিজের যৌবনকালের ছবি আর ফুল ফল রান্না সহ নানা কিছুর ছবি-টবি দিলেও ইহকালের পাপপূণ্যের জন্যে পরকালের বিচার আর শাস্তির ট্যাবু থেকে কিছুতেই বেরুতে পারে না। তাই ভাবনাটা লেগেই থাকে।

সাজনিন এখন রূপনের সঙ্গে থাকছে। আসিফ জানে। ছেলেটা নিয়মিত ওদের খবরটবর নেয়। দরকারে যে কোনও সময় ডাকলেই চলে আসবে বলে জানিয়ে গেছে। দুদিন আগে নাবিলাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল বাসায়। লুনা এমনিতেই খুব একটা ওদের সামনে যায়-টায় না। আব্বাসই বকবক করে মাতিয়ে রাখে। সেদিন তিনতলার বারান্দা থেকে সন্তর্পণে আসিফ আর নাবিলাকে ভালো করে দেখেছে। বসুন্ধরায় ছোট একটি ফ্ল্যাটে অফিসকলিগ শাব্বার সঙ্গে শেয়ার করে থাকে নাবিলা। ইশকুলটিচার বাবামায়ের অসম্ভব মেধাবী মেয়ে। যে কোনও মুহূর্তে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে চলে যেতে পারে। যাচ্ছে না। কারণ ছোট ভাইটাকে গাইড দিচ্ছে। ছোটু ইউনিভার্সিটিতে ঢুকলেই চলে যাবে। আব্বাসকে সালাম দিয়ে হাত মিলিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল ওরা। এমন দায়িত্বশীল মেয়েকে কী করে খারাপ বলে লুনা!

তবু ভাবনাটা কুরে যায়, সাজনিন কি বিয়ে করবে এ ছেলেটাকে? কিংবা আসিফ? হয়তো করবে অথবা করবে না। লুনা বোঝে, বদলে যাচ্ছে তার স্বদেশ।

রাতের অর্ধেক সময় এখন দোলনাতেই কাটিয়ে দেয় সে। অন্ধকার ফিকে হয়ে ভোরের গন্ধ ভেসে আসে। আজানের আগে মুয়াজ্জিনের নিঃশ্বাসের শব্দে মসজিদের মাইকটা খড়মড় করে কড় কড় শব্দ করে বেজে ওঠে। লুনা তখন বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। ঘুম আসে, আবার আসে না। ওদিকে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে আব্বাস। ঘুম যদি বেলা এগারোটাতেও ভাঙে আব্বাস ঠিকই মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে যায়। প্রথম প্রথম ঠাট্টা করলেও লুনা বোঝে আব্বাস ওর অবসর জীবনটাকে সাজিয়ে নিয়েছে। লুনা পারছে না। মাত্র একষট্টি বছর বয়সে বাসিফুলের মতো লুনা জবুথুবু হয়ে যাচ্ছে।

ইশকুলকালের বান্ধবী টাটুম ডেকেছিল বহুবার, লুনা আয়। আমরা ইয়োগা ক্লাশ করছি আর কোভিড হারামজাদার জন্য বেকার হয়ে পড়া পরিবারগুলোতে রান্না খাবার দিয়ে সাহায্য করছি। ছাদের উপর নিজেরাই রান্ধি বাড়ি। আয় আমাদের সঙ্গে।

ইচ্ছা করে ছুটে যায়। কিন্তু কী যে আলস্য ওর মনে। কোনও দিন মন নড়ে তো শরীর নড়ে না। আবার শরীর নড়লে মন সায় দেয় না। তাই মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে অংশ নিচ্ছে ওদের সঙ্গে।

টাটুম মুখ খারাপ করে গালি দিয়েছিল, কয়লাখাকি আলসে রাক্ষুসী দেখিস নে তোর হাড়মুচমুচে ব্যারাম হবে নে। ঘুণে খাবে নে তোর শরীর। মরবি যখন সবার আগে পোকা ধরবে নে তোর ডাঁট দেখানো দুই বুকে। শোন শূয়োরনি তোর উন্নত বুক আছে বটে কিন্তু উন্নত বোধ নাই। যা তুই আফগানিস্তানে চলে যা হারামজাদি।

মাঝে মাঝে ধড়ফড় করে উঠে বসে বিছানায়। আব্বাস বিরক্ত হয়। রাগে গরগর করে, আর কত পাহারা দিবি লুনা? পারলি আটকাতে? না আমাকে না তোর মেয়েকে! ছাড়ান দে এবার।

লুনা বোঝে আপেলের খোসার মত ধীরে ধীরে পচে যাচ্ছে ওর মন। আব্বাসের বন্ধু জুবেরিভাই আর ভাবী প্রবাস থেকে নাতিকে নিয়ে ছবি দিয়েছে ফেসবুকে। ওদের মেয়ে সিঙ্গল মাদার। বিয়ের কথা বলায় মেয়ে নাকি জুবেরিভাইকে বলেছে, আদম হাওয়া যে বিয়ে করেছিল তার রেকর্ড আছে কোনও? যদি দেখাতে পারো তো তখন ভেবে দেখব। এখন যাও তো বাবা। কাজ করতে দাও।

সাজনিনও কথায় কথায় বলত, কাজ আছে মা। তোমার মতো আব্বাসের পুষ্যি হয়ে বসে থাকলে তো চলবে না।

লুনা আহত হয়ে ফিরে আসে। সাজনিনকে যা বলতে চেয়েছিল, তা আর বলা হয়ে ওঠে না। কী বলতে চেয়েছিল সে? সাজনিনও যদি রেকর্ড চেয়ে বসে!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. গত সপ্তাহে পড়েছি গল্পটা। ভালো লেগেছে। 🙂

Leave a Reply to নাহার তৃণা Cancel reply