![Day12](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2018/02/Day12.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
উর্বা চৌধুরী
একটা সময় ছিল যখন বিশ্বাস করেছি, বই পড়া বা না পড়া, ব্যষ্টিক বা সামূহিক বাস্তবটিকে খুব কিছু ভিন্নতা দেয় না। পড়েও যা, না পড়েও তাই। অতএব জ্ঞান নির্মাণের কাজে বই প্রায় অদ্বিতীয় উপায়, এমন কিছু ধারণাও ছিল না। ফলত, ‘বই পড়া কমছে’ গোছের কোনও দুশ্চিন্তাও গিলে উঠতে পারেনি সে সময়। বরং মনে হত, বেদ যদি শ্রুতিতেই এদ্দুর, আত্মস্থ করতে আটচল্লিশ বছর, তবে আর লেখা-পড়াকে কেনই বা এমন অতুল্য জ্ঞান করা হবে! এ সব প্রশ্ন যখন মাথায় নড়াচড়া করতে শুরু করল, ঠিক তখনই মালুম হল- বাজার, রাস্তা ও মেলা- এই তিনটি ক্ষেত্রে নিজের পাঁচটি ইন্দ্রিয় সচল রাখলেই মোটামুটিভাবে শিক্ষিত হয়ে ফেলা যায়।
অভিভাবকের হাত ছাড়ার পর সেইরকম করে শিক্ষিত হওয়ার টানেই বইমেলা যাওয়া শুরু। আমার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের শুরুর দিক অবধি বইমেলায় ময়দানকে সাজতে দেখেছি, তারপর যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণকে, তারপর মিলনমেলা প্রাঙ্গণকে। এবার সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক। সবাই যখন মুখ ঝুলিয়ে বসে আছেন, কপাল কুঁচকে কথা বলছেন, হাত নেড়ে ময়দানের বইমেলার মাধুর্য ও বাকি জায়গাগুলির তুচ্ছতা বিচার করছেন, তখন আমি প্রতি বছর ভেবে চলেছি, এবারেরটায় কোন রাস্তা ধরে অকুস্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করলে সময়, হাঁটা ও কড়ি সাশ্রয় করা সম্ভব। এ মুহূর্তে একমাত্র এই ভাবনাটিই আমাকে আমার আশু লক্ষ্যে আমায় পৌঁছে দেবে।
সারা বছর ছোট-বড় বই কেনার অভ্যাস থাকা সত্ত্বেও বইমেলা যাই কেন? মূলত মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখতে আর দেখতে, “কিনবেন দশ টাকায়, পড়বেন চল্লিশ মিনিট, হাসবেন একঘন্টা”- এই আর্থিক বন্দোবস্তটি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল!
ছোট থেকেই বইমেলা হবে শুনলে মনে হত, ওখানে কিছু খেতে নাই। খেলে লেখক-পাঠক, পড়াকু-লড়াকুরা নিন্দে করেন। এদিকে, খিদে তো দিব্যি পায়, খাওয়ার ইচ্ছাটাও ভাল রকমেরই পায়! আজ যেই সিঙারায় প্রথম কামড় বসিয়েছি মনে হল, দুটো বইয়ের স্টল ঘুরে আসি। দ্বিতীয় কামড় দিতেই মনে হল, একটা চটি বই কিনে আনি বরং। এমনই গেঁথে বসেছে মরাল বাইট। এদিকে নিরম্বু উপবাসে বইয়ের ভালমন্দ বোঝার মাথাটিও কাজ করে না। ঠিক এই সময়, মানে, যখন বই নিয়ে চলা তত্ত্ব অনর্থক লাগছে, তখনই আবার শিক্ষা দিল বইমেলাই। ফুড কোর্টে নানা বয়সের কর্মীরা আছেন। খাবার দিচ্ছেন। যে যেমন চান সেই মাফিক। একজনকে খাবারের দাম দিতে গিয়ে বললাম, “দাদা, বাঁহাতে দিলাম, কিছু মনে করবেন না।” শুনেই হো হো হেসে উঠে বললেন “দিদি, কাজের সময় আমার দশদিক দিয়ে দশটা হাত বেরিয়ে যায়, সবকটা কাজে লাগে, কি মনে করব!” বেজায় কঠিন এই “কাজ” কথাটি!
রোজ যা খুঁজেছি, আজ শেষ দিনেও তাই খুঁজলাম। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ, যাঁদের আমরা ‘প্রতিবন্ধী’ বলে বুঝি, তাঁদের প্রায় কোনও স্টলেই অবাধ প্রবেশের উপায় নাই। হুইলচেয়ার ঢোকার মতো চওড়া দরজা, দরজার সামনে ঢালু পাটাতন, নাহ্, নাই! বহুবার, বহু বছর ধরে বহু আন্দোলন করা হয়েছে, অবস্থান নেওয়া হচ্ছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করা কর্মীদের পক্ষ থেকে, বইমেলাকে সবার জন্য অবাধ করার দাবিতে। কিন্তু এ মেলাও বাকি পৃথিবীটার মতো ‘প্রতিবন্ধী’ রয়ে গেল!
ফুড কোর্ট থেকে ইস্কনের স্টল, প্রকাণ্ড সব প্রকাশনীর স্টল থেকে লিটল্ ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ান, দৈনিক পত্র পত্রিকার বৈভবীয় স্টল থেকে মাসিক ট্যাবলয়েডের তাড়া-ধরা হাত- সব কিছুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখে আজ বারবার মনে হচ্ছিল, আমার জীবনের দীর্ঘ ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরে এ মেলা তো আসলে বদলায়নি। বারো বছর বয়সে, ঊনিশশ’ বিরানব্বইয়ের মেলায় প্রথম কানে এসেছিল “…জাকির হুসেন/ তবলা বাজানো ছেড়ে পায়রা পোষেন…”। অদ্ভুত সেই সুর, অদ্ভুত সব কথা। এ কথা তো অস্বীকার করার জো নাই যে, এই শহর সত্যিই জানে আমার প্রথম সব কিছু। আজ কানে আসছিল তেমনই চেনা কোনও সুর, যা কারও কান প্রথমবার শুনছে, তেমনই জানা কোনও কথা, যাতে কারও মাথা প্রথমবার চমকাচ্ছে। সেই রকম কোনও গান, যে গান শোনার পর যখন শুরু হবে সেই খুদের বাস্তব দর্শন, সে জেনে যাবে, এ পৃথিবীতে কারও মুখ ভার হলে, বিষাদজনিত কারণে কোনও নিশান অর্ধনমিত হয় না।
‘স্বকণ্ঠে’ হাতে নিয়ে তাজা কিছু মুখ ঘুরছে। এক মেলা মানুষের মধ্যে ‘স্বকণ্ঠে’-এর বিক্রেতা ও প্রচারকেরা শান্ত গলার নিম্নগ্রামের চিৎকারে দাবি করে চলেছেন, ‘ভিন্ন’ মানে ‘অস্বাভাবিক’ নয়। ‘ভিন্ন’ মানে ‘ত্যজ্য’ নয়। ‘সহিষ্ণু’ হোক এই সমাজ। ‘প্রাপ্তমনষ্ক’ হোক মানুষ। ‘আমি’ চিনি নিজেকে, জানি নিজেকে, বুঝি নিজেকে-আমাকে ‘নিজেকে’ চিনিয়ে, জানিয়ে, বুঝিয়ে দিতে হবে না এই সমাজের। এ সমাজ বন্ধ করুক ‘যৌনতা’কে ‘কলুষিত’ করা। বন্ধ করুক ‘যৌন বহুমুখিতা’র বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ‘একমুখিতা’য় পরিণত করা।
চা-স্টলের কাছাকাছি হয়েছে শিশুর অধিকার রক্ষা কমিশনের স্টল। স্কুলছুটের প্রবণতা, শিশুশ্রম, শিশুপাচার, বাল্যবিবাহ, শিশুর উপর নির্যাতন ঠেকানোর এক জরুরি উদ্যোগ। দফায় দফায় নানা কার্যক্রম চলছে সেখানে। ভালই লাগছিল দেখতে। অনেক বাচ্চা এসেছে। তাদের রকমসকম প্রাণবন্ত, ব্যস্তসমস্ত। মনীষ ট্রে হাতে করে নানা স্টলে চা দিচ্ছে। ধাপার কাছে ওর বাড়ি। “আপ স্কুল যাতে হো?” জিজ্ঞেস করায় এক দমে বলে দিল “ঘর কে বগল মে হি মেরা হিন্দি ইস্কুল হ্যায়। গেয়ারা বাজে সে চার বাজে তক ইস্কুল মে রহতা হুঁ। রোজ যাতা হুঁ। সচ্চি! খালি কল অওর পরসো নেহি গয়া থা, পাপাকে সাথ ইঁহা আনা থা না, ইস লিয়ে। আজ তো ছুট্টি হ্যায়, আন্টি!” এ যেন ধার্মিকের জপমন্ত্র। স্কুল যাওয়ার মতো বাধ্যতামূলক মৌলিক অধিকারচর্চা সে করে কি না, তার উত্তর দিতে দিতে আর ভুল হয় না ইদানীং। ফুল প্যান্ট আর প্যান্টে গোঁজা ফুল শার্ট পরা চার ফুটের মনীষ এবছর সিক্সে উঠেছে। ওর রকমসকমও প্রাণবন্ত, ব্যস্তসমস্ত।
দু’দিন আগেই হতভাগ্য কিছু আগমার্কা সংস্কৃতিপ্রেমী এক ডানপিটে প্রেমিকাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, এ জগতে ফুল ফোটাতে হলে “ঠাস্ ঠাস্, দ্রুম দ্রাম” শুনে খটকা লাগলে চলে না, পটকা ভাবলেও চলে না। ভয়ংকর নাদে এখানে সাংস্কৃতিক ক্ষমতার প্রকাশ করতে হয়। দুম্ করে চিরতরে চলে যাওয়া তরুণ কবি সুপ্রভাত রায়ের বইটির উদ্বোধন হতে দেয়নি জার্নালিস্ট ক্লাব কেবল দশ মিনিট বাড়তি সময় লাগত বলে। মৃত্যুতে চলে যাওয়া প্রেমিক সুপ্রভাতের অর্ধসমাপ্ত বই পনেরো দিনের উদ্যোগে ছাপাতে পারার উচ্ছাসে তার বছর সাতাশের প্রেমিকার জ্বলজ্বল করা চোখের দিকে তাকাতে অনেকটা মনোবল জোগাড় করতে হল আমায় আজ। এদ্দিনে বুঝি টের পেলাম, অভিসারে অগম পারে যাওয়া মানে কী!
বইমেলা আমার কাছে মনের ভাবপ্রকাশের উৎসব। গ্রাম্য থেকে শহুরে, দেহাতি থেকে শুদ্ধ, গুরু থেকে চণ্ডাল, বাংলা থেকে অবাংলা, মুখের ভাষা থেকে চিহ্ন ভাষা- নানা ঘরানার ভাষার অস্তিত্বের উদযাপন। এখন বুঝি ‘বই পড়া’ আসলেই বড় কাজের জিনিস। স্পেকুলেশানের যথার্থতা আর বহুমাত্রিক পারসেপশানের ক্ষমতা বাড়ায়। আগামী সব কিছুকে নিয়ে রাজনৈতিক দ্বিধায় থাকা আমার প্রজন্ম, আগামী বছরের বইমেলার অপেক্ষায় থাকুক- এই ইচ্ছাকে মনে বেঁধে নিয়ে এই লেখা আর এবারের বইমেলার নটেগাছটি মুড়োক।