![syamantak](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/06/syamantak.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
স্যমন্তক ঘোষ
লেখক পেশায় সাংবাদিক, সমাজকর্মী ও প্রবন্ধকার
নোনা হাওয়াও স্বস্তি দিচ্ছে না। সূর্যের তেজ এতটাই যে, বারবার হাতে-মুখে জল দিয়েও সব কেমন ঝাপসা লাগছে… ভাঙা বাঁধের উপর দলামচা করে তৈরি হওয়া শেল্টারগুলোর ভিতরে ঢোকা যাচ্ছে না… প্রেশার কুকারের মতো গুমোট…
তারই মধ্যে নতুন মাটি ফেলে, নতুন করে বাঁধ তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন স্থানীয় মানুষজন। তাঁদের নিশ্চয় আমাদের মতো গরম লাগে না। অথবা, লাগলেও বলেন না – দিব্য হাহা-হিহি করতে-করতে হাতে-হাতে মাটির চাঙড় ভাটিয়ালি গানের মতো ছন্দে-ছন্দে পৌঁছে যাচ্ছে ভাঙা বাঁধের গায়ে। যে দিকে বাঁধের অবস্থা আরও খারাপ, সে দিকে জেসিবি নেমেছে কাজে… দৈত্যের মতো যন্ত্র…
ভিখিরি
ছোট মোল্লাখালির যে জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেই গ্রামের নাম কালীদাসপুর। নদীর ও-পারে মরিচঝাঁপির জঙ্গল। ’৭৮ সালের কথা এ-অঞ্চলের মানুষ বলতে চান না… কথা উঠলেই ঝটিতি প্রসঙ্গ পালটে ফেলেন। কেন, কে জানে? জানি না, সেই ভয়াবহ ‘অপরাধ’-এর সময় এ-পারের পশ্চিমবঙ্গীয় মানুষ অপারেশনে সাহায্য করেছিলেন কি না? গ্রামের এক প্রবীণ অন্য এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভুল করে একবার পূর্ববঙ্গীয়দের ‘ভিখিরি’ বলে ফেলেছিলেন… সে সময়ে শহুরে নেতাদের মুখেও নাকি এ শব্দ শোনা যেত… পাঠক, দোষ ধরবেন না… শহুরে আধুনিকতার চোখে জল-জঙ্গলের সমাজ-রাজনীতি নিয়ে বই লেখা যায়, পিএইচডি-ও হয়, কিন্তু সেই যাপনের ধারেকাছেও পৌঁছনো যায় না…
আধুনিকতা
গরমের কথা বলছিলাম। নোনা গরমের একটা অদ্ভুত চরিত্র আছে – চামড়া কেবল পোড়ায় না, তার ওপর মেমব্রেনের মতো একটা সাদা চাদর তৈরি করে। যত বয়স, চামড়ার বলিরেখা যত প্রকট, সাদাটে ভাবও তত বেশি। সাদা কাপড়ের ওই দিদিমার চেহারায় সাদা-কালোর সেই কনট্রাস্ট যেন একটু বেশিরকমই বেশি… তবে, কে জানে, তা চোখের ভুলও হতে পারে…
নোনা জল ঢুকে-যাওয়া এই প্রত্যন্ত গ্রামে খানিক আগেই এসে লেগেছিল শহরের বোট। আপাদমস্তক কোভিড প্রোটেকশনে থাকা দাদা-দিদিরা বোট থেকেই বস্তা-বস্তা ত্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন। দু’হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের কাছে, এ-দৃশ্য অনেকটা হরির লুঠের মতো। সুন্দরবনের মানুষ একে ‘ত্রাণ ধরা’ বলেন। যিনি যত ভাল ফিল্ডার, ক্যাচ ধরার দক্ষতা যাঁর যত বেশি, দিনের শেষে তাঁর জিম্মায় তত বেশি মাল – থুড়ি, ত্রাণসামগ্রী…
ওই দিদিমাও গিয়েছিলেন ত্রাণ ধরতে। বাঁধ মেরামতির সৈনিকদের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বাউন্ডারির বল ধরার জন্য। নৌকোঘাট থেকে ফিনফিনে প্লাস্টিকের বস্তা পিঠে নিয়ে ন্যূব্জ শরীরটা যখন ফিরছে, দিদিমার সঙ্গে প্রথম বাক্যালাপ হয়েছিল তখনই। সত্তর অথবা পঁচাত্তর অথবা আশি বছরের ওই বৃদ্ধা পেয়েছেন এক বস্তা স্যানিটারি ন্যাপকিন…
রোদের তেজ প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। ঘাট ছেড়ে ত্রাণের নৌকো ততক্ষণে মাঝনদীতে– বিধ্বস্ত মানুষের হাতে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার তৃপ্তি নিয়ে শহর নিশ্চয়ই ততক্ষণে স্যানিটাইজ করে নিচ্ছে নিজেকে!
গ্রামও তাই করছে। ভাঙা বাঁধের ওপর গ্রামের তরুণ প্রজন্ম ত্রাণ-মারফত-জোটা ব্যবহৃত জামাকাপড় ডাঁই করে জমিয়ে রেখে যাচ্ছে। ও জামা গায়ে দেওয়া যায় না। ঘর পাকা হলে ন্যাতা হয় যদিও…
দূরে তখন পিঠে বস্তা নিয়ে বাঁধের ওপর দিয়ে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে ফিরছেন দিদিমা। বাড়ি বা শেল্টার ক্যাম্পে পৌঁছে দিদা যখন ত্রাণের বস্তা খুলবেন, কী করবেন তিনি? জানতে ইচ্ছে করছিল… ভয়ে তাঁকে অনুসরণ করতে পারিনি…
ভাঙন
আমফানে বিধ্বস্ত হয়েছে দক্ষিণবঙ্গ। সুন্দরবনের চেহারা তাও একরকম… সুন্দরবন-লাগোয়া উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বহু জায়গার অবস্থা তার চেয়েও ভয়াবহ। মানুষ সামান্য খাওয়ার জলটুকু পর্যন্ত পাচ্ছেন না। যে যত প্রান্তিক, তাঁর হাহাকার তত বেশি। এ কি কেবলই প্রকৃতির রোষের কারণে?
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফ্রেজারগঞ্জ-নামখানা থেকে উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ, ন্যাজাট – আমফান-বিধ্বস্ত বিস্তীর্ণ এলাকার সামান্য কয়েকটি জায়গায় পৌঁছনোর চেষ্টা করেছিলাম আমরা। বকখালির পশ্চিম অমরাবতী, সুন্দরবনের দুয়ারির জঙ্গল, পুঁইজালি, মিনাখার মোহনপুর, সোনাখালির নাপিতখালি, সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি জঙ্গলের উলটোদিকে ছোটমোল্লাখালি, হাসনাবাদ হিঙ্গলগঞ্জের শুলকুনি, ঘেরিপাড়া, খলসেখালি, আদ্যাচক… কিন্তু, তার বাইরেও বিস্তীর্ণ এলাকার অগুনতি জনপদ আমাদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেল এবার…
বলতে দ্বিধা নেই, আমফান হয়তো অনেককেই বাঁচিয়ে দিয়েছে। কষ্ট বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু শহরের মধ্যবিত্তের চোখ পড়েছে তাঁদের দিকে। ত্রাণের টাকা উঠেছে… পৌঁছেছে খাবার, পানীয় জল, ওষুধ, ত্রিপল। কিন্তু আমফানের আগেও প্রায় এতটাই বিপন্ন ছিলেন মানুষ… লকডাউনে পেটে খিল এঁটে বসেছিলেন সকলে। না-খেয়ে মরে যাওয়ার মৃত্যুভয় আয়লার পরেও এতটা দেখিনি, যেমন আমফানের পরে দেখলাম…
আমরা সবুজ পাঠশালা-র বন্ধুরা দুর্গত মানুষের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছিলাম আরও অনেকের মতোই। আরও অনেকের মতোই ত্রাণ শেষ করে বোটে উঠে পরিতৃপ্তির প্রলাপ বকতে-বকতে নিজেদের স্যানিটাইজ্ড করে নেওয়ার কথা ভেবেছিলাম নিশ্চয়। ফেরার পথে পালটা কিছু দৃশ্য নিয়ে ফিরলাম… পাঠক, মাফ করবেন… সে দৃশ্য ঝড়ের পরের ভাঙনের নয়… আসলে, সভ্যতার…
আর একটু সভ্য হতে পারি না আমরা?
হেডার এবং লেখার সঙ্গের ছবিগুলি লেখকের তোলা