মৃণাল ও একটি অনবহিত সিনে-সংবাদ

শাশ্বত বসু

 

ভোরের জেদি একগুয়েঁ ধোঁয়া আর ছেঁড়া ছেঁড়া বাক্সপুঁটুলি থেকে ভেসে আসা ভ্যাপসা গন্ধের মিশেলে, ভিজে যাওয়া সংস্কৃতিশূন্য সকালটার একটা নিজস্ব গন্ধ আছে। গরম ভাতের ফ্যান, ডাস্টবিনে ফুলে ওঠা মাছ কিংবা সারা রাত জেগে বাজারটার এক কোনায় পড়ে থাকা মুটেমজুরের গায়ের তেতো ঘামের গন্ধ, সবকিছু মিলে মিশে গিয়ে একটানা পচা একটা গন্ধ তৈরি হয় এই সকালটার গায়ে। মশলা বাজারটা খুলতে এখনও দেরি আছে, এখন শুধু মাছের বাজারটা ঘিরে শব্দের আনাগোনা। ভারী বরফের চাঁই মাটিতে আছড়ে ভাঙার শব্দ, মুটে-মজুরদের লরি থেকে মাছ খালাস করার সময় দেহাতি হিন্দি আর বাংলা মেশানো খিস্তির বলিষ্ঠ বিস্ফোরণ, স্বস্তার ঠেলাঠেলি আর মাছবাজারে দর হাঁকাহাঁকির শব্দ। হারানিধির এসবে অভ্যাস হয়ে গেছে। এই শব্দটা তার কানের কাছে শ্লেষ্মামিশ্রিত ঘড়ঘড়ে গলায় বাজে ঘন্টির মতন। একটানা বেজে চোখের বাসি ঘুমটাকে তাড়িয়ে দেয়, অ্যালার্ম ঘড়ির আর দরকার পড়ে না। এখন তার তক্তপোষ ছেড়ে উঠে গিয়ে লবির গায়ে ঝুলন্ত বাল্বটা নেভানোর কথা। তারপর আস্তে আস্তে হারানকে তুলে পায়খানা বাথরুম সেরে বাজারের পথ ধরতে হবে। বাজারের মধ্যেই হোটেলটা, বেঙ্গল লজ। একইসঙ্গে লজ ও ভাতের হোটেল। অবশ্য হারানিধি যখন প্রথম এখানে কাজে লেগেছিল, তখন এটা শুধু ভাতের হোটেলই ছিল। এই হোটেলটার মালিক শশধর গুপ্ত, এই এলাকার গুপ্তদা, রামনিধির হাতের ছোলা দিয়ে কুমড়োর তরকারি, হালকা হিং ফোড়ন দিয়ে, সঙ্গে সর্ষে দিয়ে বেগুনের ঝাল দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে বলেছিলেন, কাঠবাঙাল হয়ে ঘটিবাড়ির রান্না কী করে শিখলে হে? বাজারের মাঝখানে সদ্য খোলা ভাতের ঝুপড়িটার খাবার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হারানিধি উত্তর দিয়েছিল, আজ্ঞে কত্তা, মায়ের কাছে। ছেলেবেলায় বাবা মারা গেছেন, আমরা তিন ভাই-বোন, মা এদিক ওদিক করে যা পেত, রেঁধে বেড়ে খাওয়াত। মায়ের হাতের রান্না ছিল অমৃত, ছোলা দিয়ে মোচার ঘন্ট রাঁধত ঘটিবাড়িকে হার মানিয়ে দেবে। আশেপাশে গাছের পাতার চাপে পৃথিবীটার সব ফুটো বন্ধ হয়ে যাবে এমন একটা সময়ে শশধর তাকে প্রস্তাব দেয়, আমার দোকানে কাজ করবে? উড়ে বাউনটা সেই যে দেশে গেছে আর ফেরার নাম নেই। আপাতত মাস গেলে ৩০০ টাকায় ঢোকো, থাকা খাওয়া সব আমার ওখানেই, পরে আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দেওয়া যাবে। সেই থেকে হারানিধি গুপ্তদার হোটেলে নোঙর ফেলল। এই এত বছরে শিয়ালদা ব্রিজের উপর দিয়ে চলা টিং টিং ঘন্টির ট্রামগাড়িটা চলে গেছে কয়েক লক্ষ বার। ট্রামের ভেতর বসে থাকা মুখটা জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে বাজারটাকে দেখেছে কয়েক অর্বুদ মাইক্রো সেকেন্ড ধরে, ধুলোকাদা জড়ানো একটা হাওয়াকে বুকে আঁকড়ে। রামনিধি আজ রাঁধুনি থেকে হোটেলের কত্তা হয়েছে। কয়লার উনুনের গনগনে আঁচ, ছাঁকা তেলে কড়া করে ভাজা মাছ, পুইশাঁকের চচ্চড়িতে মেশানো পাঁচফোড়ন— এসব ছেড়ে হারানিধি এখন খাবার সময় খদ্দেরদের দেখভাল করে। কার কী অসুবিধা, কে কী নেবেন, কার ভাত লাগবে, কার ডাল তরকারি, কে কী মাছ নেবেন, কোন টেবিলে কত হল। গুপ্তদা বাজারটা ও ছাড়া কারও হাতে ছাড়েন না। নেহাত পড়াশোনাটা বেশিদূর শেখেনি হারানিধি, নাহলে হয়তো হিসেবের খাতাটাও ওই দেখত। আজ থেকে তিরিশ বছর আগের রানাঘাট স্টেশনের বাইরে একটা মাটির দেওয়ালের বাড়িতে খড়ের চালায় ভাতের হোটেল খুলে বসা বছর তেইশের তরতাজা যুবক হারানিধি কলকাতায় এসেছিল কলোনির বিশুদার হাত ধরে। বাজারের মাঝের জামগাছটা তখন সদ্য মাথা তুলছে। ওই গাছটাই একদিন আবছা আলো-আঁধারিতে ভেবে নিয়েছিল ভবিষ্যতে সে বনবীথিকা হবে। আজ এলাকার ছেলেপুলেরা ঢিল ছুড়ে গাছটা থেকে জাম পাড়ে, ওর শরীর জুড়ে চামড়ায় ফাট দেখা দেয়, মুছে যায় স্মৃতির জন্মদাগ। গাছটা জুড়ে কয়েক শত কাক যত্নশীল সংশয়হীনতায় ঘিঞ্জি বাসা বেঁধেছে নির্লজ্জ বংশবিস্তারের আশায়। রোজ বিকেলে নিয়ম করে হারানিধি ওদের মুখে ছুড়ে দেয় এঁটো ডেচকির গায়ে লেগে থাকা পীতাম্বরী ভাতের দলা। কাকগুলোর মাঝে বুক চিতিয়ে মাস্তানি করে বেড়ায় একটা শঙ্খচিল, ওইটাই হারানিধির বাপ। বাকিগুলো হয়তো ওরই পূর্বপুরুষ সব, জন্মান্তরে অনস্তিত্ত্বের সাজা কাটছে। বাজারের মাঝখানের পোড়ো বাড়িটার ভাঙা দেওয়ালে, বাড়তি চৌকাঠে আছড়ে পড়ে ফেটে যাওয়া রোদটার গায়ে কান পাতলে বুঝতে পারা যায় রানাঘাটের রিফিউজি কলোনির হারানিধি দাস এখন বেঙ্গল লজের ভরকেন্দ্র। তাকে ঘিরে হোটেলটা ফিরে পেয়েছে এক নিশ্চিন্ত যোগনিদ্রা, বিরামহীন আগডুম-বাগডুমের মাঝেও তার নড়েটি যাওয়ার উপায় নেই। তিনশো টাকার মাসিক বেতন এখন প্রায় ছয় হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। গুপ্তদা ওর ছেলের পড়ার খরচ দেন। সেরকম কোনও অভাব অভিযোগ রাখেননি এককথায়। নিন্দুকেরা কিন্তু বলে হারানিধি শসাবাবুর গুপ্ত কথা জানে। তাই বেঙ্গল লজে তার এত খাতির। হারানিধিকে গুপ্তবাবু নিধি বলেই ডাকেন। তাই গল্পের পরবর্তী সময়ে আমরাও সেই নামটিই ব্যবহার করব।

ঘুম থেকে উঠে পড়ে হারানিধি। জৈষ্ঠ্যের ঝকঝকে ভোর আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যের তাপ গনগনে হয়ে পোড়াবে তাবৎ ব্রহ্মাণ্ডকে। গরমের দিনে বাজারটাও জেগে যায় একটু তাড়াতাড়ি। তোলা ঝি-টা আসে, এঁটো বাসন মাজে। বাসনের ডাঁই দেখলে রাগে গজগজ করে। নিধি ঘুম থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে তলায় নেমে আসে। হারানটা রান্নাঘরের মাটিতে বিছানা পেতে শুয়ে আছে, রাস্তার নেড়িটার মতো মুখ গুঁজে। নিধি গিয়ে তার গা থেকে চাদরটা সরিয়ে দিয়ে আলতো করে নাড়া দেয়।

—ওঠ বাবা হারান। উঠে পড় বাবা। ভোর হয়ে গেছে। চট করে ঘরদোরগুলো ঝাড়পোঁছ করে দে দিকিনি। ওই দেখ, ঝিটা উঠোনটা ঝ্যাঁটাচ্ছে। তোকে কতদিন বলেছি ওটার পিছু পিছু থাকতে। ও বেটির হাতটান স্বভাব আছে। ওটাকে এবারে তাড়াতে হবে কত্তাকে বলে।

নিদ্রাবিলাসী ভোরের প্রপঞ্চময় বিরক্তি নিয়ে একটা চোখ কোনওমতে খুলে হারান বলে, তুমি আর ঘ্যাঁচাঘ্যেচি করোনি বাপু, ও মাগীকে ছাড়ায়ে দিলে ওর কাজগুলো কে কইরবে শুনি? এই বাজারে তুমি হোটেলি কাইজ করার ঝি পাইবে? সেই তো মুর ঘাইড়ে এসে পুইরবে। এক পয়সা মাইনে বাড়াইবেনি ওই কিপ্টা ঢ্যামনা বুড়া!! যেতিছে যেতিছে বুড়ার যেতিছে। তুমার কী খুড়া?

কথাটা শুনে নিধি চুপ করে যায়, গুপ্তবাবুর নিন্দা শুনে সে খুব একটা অভ্যস্ত নয়, কিন্তু হারানের কথাগুলোর উপর কিছু বলতে পারে না। বেশ কিছু বছর আগে এই বৈঠকখানা বাজারে আধপাগলের মতো ছেঁড়া কাপড়ে ঘুরছিল ছেলেটা। নিধি তখন সবে হোটেলের দুপুরের খাবারপর্ব শেষ করে, সামনের সরু রাস্তাটায় একটা ঝরঝরে টুল পেতে বসেছে। এমন সময় ছেলেটা এসে খেতে চেয়েছিল। হেঁশেলে উনুনের আঁচ নিভে গেছে ততক্ষণে। এঁটো বাসনগুলো পাহাড় হয়ে পড়েছিল এক কোণে। কদাকার ডেকচির তলা হাতড়ে কিছু আধপোড়া ভাত পাওয়া গেছিল, সঙ্গে সেই ছোলা দিয়ে কুমড়োর সব্জি, ঠাকুরটা হয়তো তুলে রেখেছিল রাতের জন্য। শীতের ধুলো আর রোদ মাখা মায়াবী আলোয় ছেলেটার মেঘের মতো মুখে সেটুকু তুলে দিয়েছিল নিধি। হাপুস হাপুস বুভুক্ষুতায় থালাটা শেষ করে রাস্তার এক কোনে ছেঁড়া চাদরটা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়েছিল ছেলেটা। রাতের খাবারটা আলাদা করে সরিয়ে রেখে যখন ওর মুখের কাছে ধরতে গেল নিধি, ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল, না মাগনা খাবুনি, আমায় কাজ দাও। এর আগে দেশ থেকে ওর বয়সী একটা ছেলে ধরে নিয়ে এসেছিল নিধি। ব্যাটা মহা পেছনপাকা আর ওস্তাদ গোছের ছিল। কিছুদিন পর থেকেই কাজে ফাঁকি দিতে শুরু করল। কিছু করতে বললেই হাজার বায়নাক্কা। একদিন তো নিধির মুখের ওপর ছোটবড় কথা বলে, পয়সাকড়ি বুঝে নিয়ে কাজ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। নিধি পরে শুনেছিল ব্যাটা এই বাজারেই একটা মশলার দোকানে কাজ নিয়েছে। আসাযাওয়ার পথে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখত নিধিকে। এই ছেলেটাকে দেখে বেশ মায়া হয়েছিল নিধির। গুপ্তদাকে বলে ওকে রেখে দিয়েছিল, সেই থেকে হারান এই হোটেলেই আছে।

মুখহাত ধুয়ে, চান করে, গুরুর দেওয়া কৃষ্ণমন্ত্র জপ করে নিধি। সারা হোটেল, লজে গঙ্গার জল ছেটায়। কর্পূর আর ধুনোর গন্ধে ভুরুভূর করে লজের বাতাস। এই লজে গুপ্তবাবু যাকেতাকে ঘর দেন না। পরশুদিনই একটা ছেলেমেয়ে এসে ঘর চাইছিল, বলে কিনা ভাইবোন! বোনকে পাশের কলেজে অ্যাডমিশন করাতে নিয়ে এসেছে! নিধির দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। বন্ধ ম্যানহোলের ঢাকনা সরালে যেরকম গুমোট অন্ধকার, সেরকম অন্ধকার পেরিয়ে নিধি হেঁটে এসেছে অনেকটা দিনকাল। এখানকার অন্যান্য লজে কী হয়, নিধি খুব ভালভাবেই জানে। আর বেঙ্গল লজ বাজারের অনেকখানি ভেতরে হওয়াতে, এসব তো এখানে সুবিধে! গুপ্তদাকে ও চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিল ব্যাপারখানা। গুপ্তদাও তো কম দিন হোটেল চালাচ্ছেন না এখানে! শেষমেশ গুপ্তদা ওদেরকে বলে দিলেন, না বাপু, এখানে ঘর খালি নেইকো, তোমরা আশেপাশে দেখো।

রেডিওতে এখন নীতিকথা বাজে। বাজারের মুখটা থেকে একটা চলতি হাওয়া, আঁশটে গন্ধ গায়ে করে নিয়ে এসে নিধিকে মনে করায়, এবার মাছ কিনতে বেরোতে হবে। এই বেলা গফুরের কাছে গেলে তাজা মাছ পাওয়া যাবে, কাতলা-রুই-পার্শে-পমফ্রেট, লাল কানকো, চকচকে গা। বেঙ্গল লজের ভাতের হোটেলে কিন্তু অন্য পাইস হোটেলের মতো রোজ ২৪ রকমের মাছ পাওয়া যায় না। নিধি বাজারের ভেতর গিয়ে পকেটের রেস্ত বুঝে, ভাল মাছ বুঝে, যা নিয়ে আসে রোজ তাই রান্না হয় হেঁশেলে। বাজারচলতি মানুষজন, কলেজপড়ুয়া, বাজারের মুটে, কাঠের দোকানে আসা বোটকা লুঙ্গির ‘পালিশের লোক’, পুরু চামড়া, গোত্রহীন চৈত্রমাস কিংবা সলজ্জ আষাঢ়, সবাই জলহীন মেঘরোদহীন দুপুরে খিদের মুখে দুটো ভাত খেতে আসে, সঙ্গে হয়তো মুরগির মাংসের লাল ঝোল, ইচ্ছেমতন চেয়ে নেয় বুক, পাঁজরা কিংবা লেগপিস কিংবা হয়তো কড়া করে ভাজা পোনা মাছ সর্ষে দিয়ে, কখনও বা শুধুই মাছভাজা, ডাল, ঝুরঝুরে আলুভাজা সঙ্গে চাটনি, পাঁপড়। অবৈতনিক অবিনশ্বর খিদে আর দু-মুঠো ভাতের কোনও জাত বা কর্ম-বর্ণ-গন্ধ বিচার নেই এই হোটেলে।

বাজারের ভেতর তিনশো বছর পুরনো কোনও কার্নিশে ওঁৎ পেতে বসে থাকা কাকটা নেমে আসে। চোখ বোজার কৌশলে সুযোগ বুঝে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায় মাছের কাঁটাটা, পোষা মেনিটার মুখের থেকে। এখানে অন্য হোটেলের মতো বিরিয়ানি বা চিকেন চাপ, টমেটো সস দিয়ে সাঁতলানো চিকেন কষা হয় না। তবে নিয়ম করে পয়লা বৈশাখে রেয়াজি খাসির মাংস হয়, নিধি নিজে হাতে রাঁধে। যে-মাংসটা ও ওর মায়ের কাছে শিখেছিল। সঙ্গে হাওয়ায় কচ্ছপের গতিতে ধুলো কালি এসে, খরচ-না-হওয়া জীবনটার ধড় আর মুণ্ডুর মাঝখান দিয়ে ফস করে উড়ে গেছিল। ওর মা হয়তো সেই রান্নাটাই শিখেছিল খুলনার কোনও এক বিরামহীন ফুরিয়ে যাওয়া নদীর গা ঘেঁষে। এই রান্না শেখার গল্পটাই নিধি করে গেছে বারবার। হয়তো সেই সুদীর্ঘ ও একঘেঁয়ে বাক্যরাজির আড়ালে প্রতিবার একটা প্রায় অলৌকিক আন্তরিকতা মিশে থাকে। কিন্তু সেই একই সময়ে ওকে দেখলে মনে হয় যেন, মুহূর্তটায় ও সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত, নিঃসঙ্গ ও নিঃস্ব। নির্গুণ, নির্ঘুম একটা মুখ হয়ে আশেপাশের অপরিচিত বিবর্তনকে সাক্ষী করে, উনুন ধরিয়ে কৃষ্ণমন্ত্র জপ করতে করতে, এক মুঠো চিনি ছড়িয়ে দেয় উনুনের ভেতর।

সকালের টিফিনটায় উড়ে ঠাকুরের সঙ্গে হারানও হাত লাগায়। কচুরি, লাল আলুর তরকারি, সঙ্গে কড়া করে চা। এই টিফিনটা মূলত কলেজের মর্নিং শিফটের ছেলেমেয়ে কিংবা সেইসব ভেন্ডরদের জন্য, যারা মাল বয়ে এনে বাজারে ঢুকেছে গতকাল রাতে। সকাল এগারোটা নাগাদ ভাত চাপে। হারান হোটেলের বাইরেটায় একটা ভিজে ফেঁসে যাওয়া গামছা পরে থেবড়ে বসে আলুর খোসা ছাড়ায়। উড়িয়া ঠাকুর উনুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বিশাল কড়া চাপায়। উনুনের গনগনে আঁচে, কলকলে ধোঁয়ায় ভরে যায় চারিদিক। কিছুক্ষণ পর থেকে সেই বাতাসে পুইঁশাক কষার সুবাস এসে মেশে। গরম তেলে পিয়াঁজ ফোড়ন, সঙ্গে গোটা ধনে, লঙ্কা ছাড়ার গন্ধ।

পৌষের কোনও হিম ধরা রাতে কুয়াশার সর সরিয়ে, মৃত্যু এসে ওর মাকে নিয়ে চলে গেছিল, কোন পা-টা আগে ফেলেছিল, এখন আর মনে পড়ে না নিধির। শুধু মনে আছে তখন ওর বারো বছর বয়স, বয়ঃসন্ধির সবে শুরু। ওদের রানাঘাটের ক্যাম্পের টিনের দেওয়ালের গা ঘেঁষে উনুনের ধোঁয়ার নির্দোষ বিষ শরীরে নিয়ে ওর মা রান্না করছে, পিছনে দুটো বিড়াল বসে লেজ নাড়ছে, পাশের ক্যাম্পে খালি গলায় গলা সাধছে খুকিদি, লালশাকের রংটা কমলা দেখাচ্ছে কুয়াশা কেটে গিয়ে। এখনও কয়েকটা দিন মায়ের হাতের স্পেশাল পোনামাছের ঝোলটা রাঁধে নিধি। কড়াইতে অল্প সর্ষের তেল দিয়ে মাছগুলোকে ভেজে নিয়ে, সেই তেলেই পিয়াজ-রসুন-টমেটো-আদাবাটা দিয়ে সমানে কষতে থাকে। খুন্তি নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝুলকালির মাথা থেকে চুনসুরকি খসে পড়ে। কয়লার ধোঁয়ায় চোখ জ্বলতে থাকে নিধির। রানাঘাটের বাড়ির কাঁঠালিচাঁপা গাছটা ঢলঢলে চাঁদের পাটালি গায়ে মেখে, মৃত্যুমুখী অন্ধকারকে পিছনে ফেলে ফ্যাটফ্যাটে একটা ফণা তুলে এসে দাঁড়ায় নিধির সামনে।

দুপুরের খাওয়া পর্ব মিটতে মিটতে বিকেল চারটে। এর ফাঁকে গুপ্তবাবু ফিরে যান নিজের আর্মহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে। হারান, ঠাকুর আর বাকি ছেলেপুলে এ-সময়টা একটু গড়িয়ে নেয়। নিধি কিন্তু দুপুরে ঘুমায় না। দুপুরবেলাটায় বাজারটার অন্য রূপ। লোকজনের আনাগোনা কমে আসে অনেক। মশলার দোকানগুলো থেকে ঠিক দুপুর দুটো বেজে সতেরো মিনিটে অচেনা একটা গন্ধ ভেসে এসে নিধির নাকচোখমুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকে সজোরে টোকা মারে। একটা চাবুক মারা বাজারি হইহল্লা বাজারের মাঝখানের পেচ্ছাপখানার গন্ধটাকে চাপা দিতে চায়, উল্টে তাতে গুড়বাজারের তালপাটালির চাক ভেঙে আজ্ঞাবাহী ধরনের একটা অতি-আলো বা অতি-শব্দের মাঝে ফ্যাকাসে হয়ে যায় চড়াইপাখিটার ঘুম। এই সমস্যা কাকেরও, এই সমস্যা হোটেলের কড়িবর্গায় বাসা বাঁধা পায়রারও। গন্ধটা নিধিকে টেনে নিয়ে যায় বাজারের উত্তরদিকে। সেখানে দোকান জুড়ে ডাঁই করে রাখা শুকনোলঙ্কা, খেজুর, কাজু-কিসমিস, বাতাসার স্তূপ। শব্দহীন, ক্লান্তিহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো কত মানুষ আছড়ে পড়ে, আবার উঠে দাঁড়ায় এইদিকে। শুঁটকির একটা পচনশীল টক গন্ধ সারা গায়ে মেখে নাক খুঁটতে খুঁটতে হেটে চলে একটি শিক্ষিত ধোপদুরস্ত উন্মাদ। আকাশের নীল রংটা গড়িয়ে পরে তার পায়ের কাছে। জিতে যাওয়া-হেরে যাওয়া জীবনটার হিসেব কষতে কষতে আপন মনে বলে চলে, পচে যাবে, সব একদিন পচে ফুলে যাবে। ব্যাকটেরিয়াগুলো এই দোকানটা থেকে ছড়িয়ে গিয়ে, পচা শরীরগুলো খুবলে খুবলে খাবে। উত্তরদিকের কোনও আবর্জনাস্তূপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিধির চোখদুটো বুজে আসে। এক অদৃশ্য প্রেতাত্মা এসে যেন ভর করে তার উপর। নিধি ছাপাখানাটার পাশ দিয়ে গলির পথ ধরে, তারপর একসময় বড় রাস্তাটা পার করে এসে সার্পেনটাইন লেন বরাবর খুঁজতে থাকে তার ছোটবেলার ভাতঘুমটা। সেটা বুঝি তখন ডুব দিয়েছে দু-পাশের উঁচু উঁচু পুরনো দিনের কলোনিয়াল বাড়িগুলোর মাঝের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা একচিলতে আকাশের শূন্যতায়, নিশ্চিত ক্ষুধার সঙ্গে প্যাঁচ কষতে গিয়ে ভোকাট্টা হয়ে পড়ে আছে পাশের হুজুরিমল লেনে। সেটাকে অক্সি অ্যাসিটিলিনের শিখায় গলিয়ে গয়না বানিয়ে ফেলছে সাতপুরনো কোনও স্যাঁকড়ার দল।

জগৎ সিনেমায় বেশ কিছুদিন হল শো বন্ধ যাচ্ছে। হলমালিকের সঙ্গে স্টাফেদের আকচাআকচি চলছে কিছু নিয়ে। নিধি আজ দেখল হলের বাইরের দেওয়ালে বিশাল বড় একটা হোর্ডিং ঝোলাচ্ছে একদল লোক। নিজেদের ভেতর খিস্তিখামারি করছে, রিকশাওয়ালা, বাসের কন্ডাকটর, বাজারের মেছুড়ে, বিহারি মুটেদের মুখের খিস্তি। নিধি দেখেছে অতিপরিচিত এই বাজারটার শরীর জুড়ে জটিলতর সমীকরণের এই যে জাল বোনে কত শত দুপুর-বিকেলহীন মানবতরঙ্গ, তাদের মুখের নিতান্ত বর্জিত অপশব্দই বলে দিতে পারে তাদের আবাস, জনপদ কিংবা কতটা ইতর অনুষঙ্গে এই দৈনিক উৎসবমুখরতার মানচিত্রে তাদের আগমন। এই চত্বরে কেউ হয়তো মশলা নিয়ে এসেছে, কেউবা ত্রিপলপট্টি থেকে মাল নিয়ে গিয়ে লোকালে ব্যবসা করবে, কেউবা এসেছে অ্যাকুয়ারিয়ামের মাছ বা পাথর নিতে, আবার দু-পয়সা লাভের আশায় কেউ ক্যানিং লাইন থেকে ঝুড়ি করে ফল নিয়ে এসে বসে পড়েছে বাজারের বাইরেটায়। চিহ্নহারা কর্মব্যস্ত শিয়ালদহ, বাস-ট্রাম, ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্টের সাউন্ডস্কেপের সঙ্গে লোকগুলোর থেকে ভেসে আসা শব্দের টাকডুমাডুমের মাঝে পড়ে, এক জটিল বর্গক্ষেত্রের কোণ-বরাবর বাহকহীন পালকিতে বসে দোল খেতে থাকে নিধি।

—হালায় লুঙ্গি তুইলা তর পোদ মারে নাই?

কথাটায় সম্বিৎ ফেরে নিধির। শব্দের অনুপ্রাণনে উপরদিকে তাকিয়ে দেখে, বাঁশের ভাড়ার মাথা থেকে একটা ছেলে, খৈনি-গুটখা খাওয়া কালো দাঁত বের করে হাসছে আর তলায় ওর বয়সি আরেকটা ছেলেকে কী যেন ছুড়ে ছুড়ে মারছে। আশেপাশের জিজীবিষু জগৎটার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন এরা। বিশাল পোস্টারটার দিকে হিম হিম চোখে চেয়ে থাকে নিধি। এটা কোনও সিনেমার পোস্টার নয়। বাংলা যেটুকু পড়তে পারে তাই দিয়ে লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করে। পোস্টারটার একপাশে একটা কাঁচাপাকা চুলের লোককে দেখে চেনা চেনা ঠেকে ওর। পোস্টারটার ডানপাশে কীসের যেন একটা লিস্ট, তাতে কিছু নাম। এর মধ্যে কয়েকটা নাম আগে শুনেছে নিধি। এগুলো সিনেমার নাম। ‘খারিজ’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘চালচিত্র’। ছেলেটার মুখে যেন খিস্তির ফোয়ারা। এগুলো যেন ওর কাছে জলভাতের মতন। শব্দগুলো বড্ড কানে বাজতে থাকে নিধির। তলায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে এগিয়ে গিয়ে নিধি এবার জিজ্ঞেস করে, ও ভাই শুনছ? এদিকে শুনো।

নিধিকে দেখে ছেলেটা মুখের হাসি থামিয়ে এগিয়ে আসে— বলেন!

—এইডা কী ব্যাপার কইতে পারো?

ছেলেটার চোখেমুখে একটা অকিঞ্চিৎকর বিরক্তি খেলে যায়। দূর বাল, এইসব হইল বড়লোকগুলার ধ্যাশডামো, ওই দাদুর বুইঝলেন শত বৎসর পূর্ণ হইল. হালায় সেঞ্চুরি মারসে। ফিলিম বানাইত, তাকে লইয়া নাচনকোঁদন হইব। বুইড়া ফিলিম বানাইয়া কি ছিড়সে কেডা জানে! আমাগো কনো কামে আইসে বুড়া? কইতে পারেন?

নিধির চোখে একটা ভুতুড়ে স্বপ্নের ঝিম ধরা ঘোর লেগে আসে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নামটা পড়ে নিধি, মৃণাল সেন। নিধির চোখের সামনে কালো জানালাটার ওপার থেকে একটা মুখ ভেসে ওঠে, ধড়হীন একটা মুখ। হালকা ফুঁ দিলে উপর থেকে ধুলোবালি সরে গিয়ে মুখটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাঙামাইমার মুখ, পৃথিবীর সমস্ত মিথ্যাবাদীকে একপাশে রেখে কোনও এক অন্ধকার বিকেলে তিনি নিধিকে ডাক দিচ্ছেন— নিধু, অ নিধু, টিভিতে সিনেমা দেখাইতেসে, দেখবা না? তর লগে মুড়ি ভাইজ্যা রাখসি, আইস চাঁদ আমার। মা মারা যাওয়ার পর নিধি ছোট ভাইবোনদের নিয়ে কল্যাণী সীমান্তের মামাবাড়ি গিয়ে উঠেছিল। মামা ওদের খুব একটা দেখতে পারতেন না। অথচ নিঃসন্তান রাঙামাইমা বুক দিয়ে আগলাতেন, খালি বলতেন, নিধু মোর প্যাটের ছাওয়াল আছিল গত জনমে। জনম জনম ফিরিয়া আইস চাঁদ এই অভাগীর কোলে।

চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে আসে নিধির। পাতলা মধুর মতো টলটলে বিকেলগুলোয় কানাভাঙা অ্যালুমিনিয়ামের চায়ের কাপের উপর দিয়ে পিঁপড়েটা এদিক হয়ে ওদিকে চলে যেত। পাশের কারশেড থেকে একটা মালগাড়ি চলে যেত, অনেকক্ষণ ধরে দীর্ঘ একঘেয়ে একটা বিচ্ছিরি শব্দ করে। ওই শব্দটার পর রোদের তাত পরে গেলে ফিরে আসত অনিবার্য রোববারের বিকেলগুলো, মস্ত একটা সোনার ডিমের ভেতর দিয়ে। টিভির পর্দা জুড়ে তখন কেবল ধোঁয়া। উনুনের ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া, উঠতি ছেলের মুখের সিগারেটের ধোঁয়া, শ্মশানের চিতার ধোঁয়া। সেই দু-কূল ছাপানো ধোঁয়ার মাঝে পুরনো লেপ-কম্বলের উপর সাবানগুঁড়োর মতো ধামসে পরে থাকে নিধির অন্ধকার কৈশোর। কুয়াশা খিমচে হঠাৎ সেই ধোঁয়ার ভেতর থেকে উঁকি দেয় ওদের কলোনির গদাইদা, অল্প বয়সে যে নকশাল হয়ে গেছিল। ওকে খুঁজতে একদিন পুলিশ এল, কলোনিটা ঘিরে ফেলল চতুর্দিক দিয়ে। প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ, জংধরা একটা স্লোগান, আবার শব্দ। ব্যস, প্যালিওলিথিক যুগ থেকে একটা সংবেদনশীল আলো গড়িয়ে পড়ে নিধির চোখদুটো সাদা হয়ে গেল। 

সেদিন সন্ধ্যায় বাজারের ভিতর কালীমন্দিরটায় ফলাহারিণী উৎসব। সন্ধে থেকেই শ্যামাসঙ্গীত বাজছে। এবেলা তাই হোটেলও বন্ধ। হারান ব্যাটা কোথায় বসে গ্যাঁজা টানছে। নিধি মন্দিরে একটা প্রণাম ঠুকে জগৎ সিনেমার দিকে হাঁটতে শুরু করল। দোকানপাট একটু একটু করে বন্ধ হতে শুরু করেছে সবে। সিনেমাহলের টিকিট কাউন্টারের সামনে গিয়ে নিধি সোজা জিজ্ঞেস করল, ইভনিং শো-এর একটা টিকেট হবে?

—আরে টিকিট লাগবে না, এটা সরকারি শো। মৃণাল সেন রেট্রোস্পেক্টিভ।

কথাটার মাথামুন্ডু কিছু বুঝল না নিধি। ফ্রি-তে সিনেমা! এও আবার হয়! চুপচাপ ঢুকে অন্ধকার হলে বসে পড়ল একটা চেয়ার দখল করে। হলে সর্বসাকুল্যে পাঁচটা লোকও নেই। অনেকদিন হলটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে, সিটগুলো ধুলো পড়ে গিয়েছে। ফাঁকা হলের সুবিধে নিতে ছেলে-মেয়ে সব হলে ঢুকে কোণের সিটগুলো দখল করে নিয়েছে। এরই মধ্যে পর্দায় সিনেমা চলছে— খারিজ। সিনেমাটা নিধি দেখেছিল বহু বছর আগে। নিধির তখন কাঁচা বয়স। শেষ বিকেলের অতি বেগুনী রশ্মি তখন স্পর্শ করেনি ওদের ক্যাম্পের ভেতর চৌকির তলায় উপুড় করে রাখা কাঁসার বাসনগুলোকে। ছবিটাকে তখন খুব সহজ লাগেনি নিধির। দূরদর্শনের পর্দায় সেদিনও পালান মরেছিল কলকাতা শহরের বুকে কোনও এক হাঁড়কাঁপানো শীতের রাতে ভেন্টিলেটরবিহীন মৃত্যুকূপে, একটু উষ্ণতার আশায়। পালান আজ এই হলের মধ্যে আবার মরে, পালানদের জন্মই বুঝি হয় শুধু মরবার জন্য। মৃত্যুর আগের যে ব্যথা ও বিষণ্ণতা, সেটা ওরা টের পায় না ঠিক করে। বড় অসাবধানী মৃত্যু। ৩০ ফুটের পর্দা জুড়ে পালান পুড়ছে, ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে গোটা হলটা। সেই নামগোত্রহীন ধোঁয়াটা কুণ্ডলী পাকিয়ে এই দমবন্ধ কালো ঘরটায় কাঁদতে থাকে, পালানের বাপের মুখ হয়ে। মৃত্যুর কম্পাঙ্ক ক্রমে স্থির হয়ে এলেও মৃত্যুবোধটা আত্মগোপন করতে পারে না কোনওভাবে। বেঙ্গল লজের প্রথমদিকের দিনগুলোর কথা মনে পরে যায় নিধির, কিংবা আরও আগের কথা, যখন ও বাজারের ভিতর দোতলা ভাঙা বাড়িটার এক কোণে পড়ে থেকে রাত কাটাত। কালাচ সাপের মতো ঘুমহীন শীতের কোনও রাতে বিহারি মুটে দুটো, মৃত্যুমুখী অন্ধকারটাকে গায়ে পেঁচিয়ে এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে। এক ধাক্কায় ওদের ছিটকে ফেলে দিয়ে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছিল ও। মুহূর্তে শহরটার সব জাদুগরি উধাও হয়ে গিয়ে, নিধি ফিরে গেছিল রানাঘাট ক্যাম্পের ভিটেমাটি ফেলে আসা পোড়া লেগে যাওয়া জীবনে। গলাটেপা মধ্যরাতে বাজারের অলিগলি ঘুরে, হাড়ভাঙা শীতটাকে সঙ্গে করে মুখোশহীন পৃথিবীর ছবি এঁকেছিল খোলা আকাশের নিচে নীল রং ধার করে।

রাত নটায় শো শেষ হল। পুরো হল জুড়ে তখন শুধু নিধি আর তার ঠিক বিপরীত গোলার্ধের শতবসন্ত পার করা একটি মানুষ ও তাঁর সৃষ্টি করা সার্বভৌম জীবনচেতনা। গত দেড় ঘন্টা ধরে যিনি চিরবিচ্ছেদের দাঁড়ে নিধিকে টেনে নিয়ে গিয়ে, ওর জীবনের আকাঙ্ক্ষাকে আরও তীব্রতর করে তুলেছেন। নিধি এখন আরও তীব্রভাবে বাঁচতে চায়, ওর বর্তমান আর ভবিষ্যতের আবর্তে। ঠিক এমনিভাবে বাঁচতে নিধি শেষ কবে চেয়েছিল?

হল থেকে বেরিয়ে নিধি হোটেলে ফেরে না। আজ রাতটা এমনিতেও ঘুম হবে না। একটু পর বাজারের ভেতর মন্দিরের কীর্তন বন্ধ হয়ে হিন্দি গান চালিয়ে মদ খেয়ে উদ্দাম নাচ শুরু হবে। কখন থামবে কে জানে! অনেক রাতে ফিরে আসবে নিধি ওর চেনা জগতে। বাজার থেকে ধেড়ে ইঁদুরগুলো দৌড় দেবে, খেলার মাঠের গোলহীন স্টপারের মতো। হোটেলের হেঁশেল জুড়ে এঁটো নিয়ে লোফালুফির প্র্যাক্টিস শুরু করে দেবে। নির্বাক দর্শক হয়ে সেই খেলা দেখবে নিধি। মনের ভেতর তপতপে একটা সেন্টিমেন্টাল মনস্তাপে, আরও ভাল দর্শক হয়ে ওঠার প্রস্তুতি নেবে।

কাল সারারাত ধরে নিধি ভেবেছে গুপ্তদাকে বলে জগৎ সিনেমায় যদি সবকটা বই ও দেখতে পেত! পয়সা তো লাগছে না। কিন্তু কি ভীষণ একটা উত্তেজনা! যেন খামখেয়ালি মধু তামস, সংস্কারহীন যজ্ঞ চালাচ্ছে পুরো জায়গাটা জুড়ে। সেই যজ্ঞের আগুনে ওর পুড়তে ইচ্ছে করে ভীষণ। ওর গলার কাছটা শুকিয়ে আসে। অস্বাভাবিক খিদেতে পেটটা মোচড় দিয়ে ওঠে। মনে হয় গায়ে চাপানো ধার করা চামড়াটা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে, লালচে মাংসটাকে প্রত্যক্ষ করে। আবার একটা শব্দ হোক, হাজার মানুষের সমবেত কোরাস হয়ে সেটা রক্তারক্তি একটা কাণ্ড ঘটাক। ইন্টারভিউ, কলকাতা ৭১, বাইশে শ্রাবণ, একদিন প্রতিদিন, সব কটা সিনেমা নিধি দেখতে চায়। ওর নিশ্চল জীবনে গলগল করে প্রাণ ফিরে আসে যেন। সন্ধের পরে ওর তো আর তেমন কাজ থাকে না হোটেলে, গুপ্তদা কেন ওকে ছুটি দেবেন না কদিন হাফবেলা করে! ইনসমনিয়ার রূপ ধরে এই কথাটা বার বার নৈতিকতা আর হকের সমকালীন সঙ্ঘাত হয়ে বাজারের চার দেওয়ালের মাঝে ধাক্কা খেয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে। জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নিধি। ওর কণ্ঠ সময়ের কোনও অদৃশ্য কোণ থেকে ওর মুখে মলত্যাগ করতে করতে উড়ে গেছে সংক্রান্তির দিকে।

মেয়েটা পাশের কলেজে পড়ে। রোজ সকাল-দুপুর বেঙ্গল লজে খেতে আসে। নিধিকে ‘কাকা’ বলে। মেয়েটা খেতে এলে আবদার করে এটা সেটা। মাছের মুড়ো খাওয়ার খুব শখ মেয়েটার। একটু বড় মাছ আনলে মুড়োটা টিফিনবক্সে ভরে দেয় নিধি। মেয়েটাকে দেখে মা-মরা ভাইঝিটার কথা মনে পড়ে, কলেরায় অকালে চলে না গেলে আজ এই বয়সেরই হত। মেয়েটার বাড়ি মছলন্দপুরে। কলকাতার কলেজে পড়বে বলে বাড়ি-ঘর-দোর ছেড়ে এসেছে। ঠিক যেমন একদিন নিধি এসেছিল এই মায়ার শহরটায় ওর বেড়া টপকানো ইতিহাসটাকে একটা এলেবেলে ধূলিকণা দিয়ে ঢেকে ফেলে। নিধি নিজে ইস্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি হয়তো, কিন্তু পড়াশুনার বেশ কদর করে। কলেজের দিকে যেতে গিয়ে যে প্রকাণ্ড পুরনো দিনের বাড়িটা, দুধারে দুটো পেল্লাই প্রাগৈতিহাসিক থামে ভর দিয়ে পার করে দিল কাগের ডিম বগের ডিম কত গ্রীষ্মকালীন সৌরঝড়, সেটা ইদানিং লেডিস পিজি হয়েছে। মেয়েটা ওখানেই থাকে। সারাদিন কলেজের পর রোজ সন্ধেবেলা মেয়েটা টিউশন পড়াতে যায় রাজাবাজার, বেলেঘাটা। নিধিকে একদিন বলছিল, ঘরে ঠিক কইরা চাল চড়ে না কাকু, বাপডা আমাগো ছাড়ি অন্য মাইয়ার লগে পলাইসে তা প্রায় এগারো বস্যর হইল, বাকি ভাইবোনগুলা তখন খুবই ছোট আসিল। পড়ার খরচডা নিজেরেই চালাইতে হয়। কাল রাতে মেয়েটা খেতে আসেনি, আজ সকালেও না। আজ দুপুরে শরীর-টরীর খারাপ নাকি জিজ্ঞেস করায় ওর বন্ধুটা বলল কাল রাতে নাকি পিজিতেও ফেরেনি মেয়েটা। ফোন করলে ধরছেও না। একটা মনখারাপের দুশ্চিন্তা সন্ধ্যা কিংবা মাঝরাতের হাওয়ায় উড়ে এসে জুড়ে বসল নিধির নশ্বর জীবনে। এর আগে কারও জন্য এত ভাবনা হয়নি ওর। মেয়েটা হয়তো ওর কেউ না, আবার এই শহরটার সঙ্গেও কোনও আত্মীয়তা নেই মেয়েটার। এই শহরের রাতের আলোগুলোর বুকে গজিয়ে ওঠা অনভিপ্রেত মাংসপিণ্ডের মতো মেয়েটার অবস্থান। হয়তবা ওর হারিয়ে যাওয়ার খবর পিঠে ডানা লাগিয়ে উড়তে গিয়ে চাপা পড়ে যাবে গায়ে ফোস্কা পরা আলোর কোলাহলের মাঝখানে। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কে ওর খবর নেবে? নিধি কি একবার মুচিপাড়া থানায় যাবে? কী উত্তর দেবে যখন পুলিশ ওকে জিজ্ঞেস করবে মেয়েটা ওর কে হয়? বাঙাল কথায় একটা প্রবাদ আছে, আলায় বুলায় না, আমি কার মাউসা? ভয়ানক একটা রাগ পায় নিধির। মনে হয় এই বিষণ্ণ, পরশ্রীকাতর, আত্মকেন্দ্রিক শহরটার মুখে গরম তেল ছুড়ে মারে। কিন্তু রাগটা কেন হয় ওর? প্রতিদিন এরকম কতশত মেয়েরা নিয়ম করে হারিয়ে যায়, এই শহরের পেটের ভেতর গজিয়ে ওঠা অর্ধেক আলো আর অর্ধেক অন্ধকারের ছায়াপথে। তাদের কজনকে পুলিশ খুঁজে বার করতে পারে? নচ্ছার হারানটা শুনে বলে, বুড়ো, তোমার ভীমরতি হইসে, ওই মেইয়ে কে লাগে তোমার? হাওয়ার খবর রাইখো বুড়ো? কলেজির ভিতর নেতামন্ত্রীর ছেলেরা আইসে টপ মাগীদের লিয়ে ফূর্তি কইরে যায়। রাতেও নাকি কলেজির কমনরুম খুলি রেখি দেয় দারোয়ানডা। দেইখগে যাও এ মাগীও লাইনে নামিসে, পুলিশে ধরিসে নয়তো যমডায় ধরিসে। হারানের হলদে দাঁতের নির্লজ্জ হাসিতে কাঠফাটা দুপুরে সারা শরীরে যেন আগুন ধরে যায় নিধির। সজোরে এক থাবড়া কষিয়ে দেয় হারানের গালে, মুখ সামলে কথা কইস ছ্যারা, মাইয়াদের লগে কী কইরা কথা কইতে হয় জানস না?

—হ্যাঁ তুমার মাইয়াডা তো সতীলক্ষ্মী ছিল। বুড়ো তুমি বইলা কিছু বুইল্লাম না। অন্য কেউ হুইলে না…

অসংবৃত মেজাজটা লাগাম ছাড়িয়ে দেশের ভাষা মুখ দিয়ে বের করে এনেছে নিধির। কিন্তু এই অনাম্নী অঙ্গনা কৃষ্ণবেণীর জন্য কেন এত রাগ আসছে নিধির? উত্তর ওর নিজের কাছেই নেই। হয়তো অনেকদিনের জমানো অনেক না-বলা ক্রোধ-হিংসা-স্বার্থপরতা জমা হয়েছিল। জীবনের আলো অন্ধকার হাতড়ানো দৌড়টা শেষ করার আগে, দশমীর বিকেলে কাঁটাতার ছিঁড়ে ওর সমগ্র জাগতিক অনুভূতিগুলোকে পিছনে ফেলে উঠে আসতে চাইছে একটা উগ্র স্ফুলিঙ্গ।

বর্ষার শুরুতে বাজারটার গায়ের কাপড় ভিজে যায় ফুটো অ্যাসবেস্টসের জলে। প্রৌঢ়ার শরীরের বাড়তি মেদের মতো বাজারটার ভেতর ফুটে ওঠে বেশ কিছু আঁশটে অনুষঙ্গ। ভোরের অন্ধকার চিরে হ্যালোজেন বাল্বগুলো থরে থরে সাজানো ইলিশের রুপোলী আঁশে ধাক্কা খেয়ে, আলো করে চারিদিক। শুটকির গন্ধটা এখন হোটেলে বসেই দিব্যি টের পাওয়া যায়, পেচ্ছাপখানার গন্ধটাও আরও তীব্র হয়। মশলার গন্ধটা আরও মিলেমিশে যায়। জামগাছটার শরীরে প্যারাসাইটের মতো ছাতা ফেলা কাকগুলো হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে শুরু করে দেয় ঠুমরি-টপ্পার ধ্রুপদী কলহ। সেদিন নিধি রোজকার মতন দুপুরের খাবারের তোড়জোড় করছে। হারানটা কদিনের জন্য বেপাত্তা ছিল, আজ হঠাৎ এসে হাজির, সঙ্গে বছর ষোলোর একটা মেয়ে। শ্যামলা গড়ন, পানপাতার মতো মুখ, তাতে টানা টানা ডিঙিনৌকার মতো দুটো চোখ, নিটোল স্তন, উদ্যাপী নিতম্ব। মেয়েটাকে এক ঝলক দেখে নিধির পোকায় কাটা ফুটিফাটা সাদাপাতার মতো জীবনের আগুপিছু তিরিশটা বছর চোখের সামনে সিনেমার মতো ভেসে ওঠে। হারান বলে, খুড়া বিয়া কইরা আইলাম দিশ থিকা। হারান হাত বাড়িয়ে নিধির পা ছোঁয়, ইশারায় কাজলচোখের মেয়েটিকেও নিধির পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে বলে। নিধির হাতদুটো উপরের দিকে উঠে থমকে যায়।

—আজ লাল লাল করি মাগুরের রসা রাইন্ধ খুড়া, সাথে সর্ষির তেল ছড়ায়ে আলুপোস্ত। আর খুড়া আমাদের থাইকবার ব্যাপারখানা তোমারে ম্যানেজ দিতি হবে। নতুন বৌ, বুঝই তো! এই কয়টা টাকায় কোথায় নিয়া তুলব? লজের দ্বিতলে যে স্টোরখান খালি পইড়া আসে, ওইখানেই থাইকবে লাহয়, কী কও?

ফুলকির মতো হারানের কথার তোড়ে ভেসে যেতে থাকে নিধি, ছ্যাড়া কয় কী! গুপ্তরে ম্যানেজ দিবে এই হারানিধি দাস! বুইড়া এককে নম্বরের কঞ্জুস। ঘরখান স্টোর কইরা রাখসে, সিজনে কম পয়সায় ভাড়া দেওনের লগে। আর এ আপদ কয় কিনা ওই ঘরডাতে মাইয়া লইয়া থাকব!! মনে মনে কথার জাল বোনে নিধি, সংখ্যাহীন চোখদুটো দিয়ে আপনমনে জ্যামিতিক অঙ্ক কষতে থাকে। মেয়েটার উপর মায়া লাগে তার। ইশারায় মেয়েটাকে ওর পিছু পিছু আসতে বলে, হোটেলের ভেতর ঢুকে নিধি তাকে নিয়ে দোতলায় ওঠে। স্টোরটা খুলতে বলে সামনে পড়ে থাকা নোংরা তক্তপোশটার দিকে ইঙ্গিত করে বলে, মা, এইখানে একটু বসো, আমি দেখি ঘরখানা একটু সাফা করাই। মনে মনে ভাবে, গেল-জনমে তুই আমার কেডা আছিলি রে? তোরে দেইখ্যা এত মায়া লাগে ক্যান? দূর থেকে ঠাকুর চাকর ঝি সব হাঁ করে দেখছিল ওদের। এর মধ্যে বাজার থেকে কেঁদো একখানা মাগুর কিনে নিয়ে এসেছে হারান। মুহূর্তে খবরটা আশেপাশের দোকান ছুঁয়ে বাজারের ঘিঞ্জি গলিগুলো দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, মহাত্মা গান্ধি রোড আর বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ক্রসিংয়ে এসে থমকে দাঁড়াল। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সস্তার ছাপা শাড়িতে করে নবদম্পতির সঙ্গে যে হাওয়াটা হোটেল অবধি এসেছিল সেটার কাঁধে করে গিয়েই উঠল এবার শসাবাবুর কানে। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় তার পায়ের ধুলো পড়ল বেঙ্গল লজে। অন্যান্য লোকের উপর বেশ একটু চোটপাট করে উপরে উঠে গেলেন তিনি, কিছুক্ষণ পর টিউবলাইটের ফ্যাকাসে আলোতে, উপরে ডাক পড়ল হারানিধি আর হারানের।

—এসব কী শুনছি রে হারামজাদা, মেয়েছেলে নিয়ে ঢুকেছিস লজে? এত সাহস তোর!! নিধির ছায়ায় নিজেকে কি মহারাজা ভাবছ বাঞ্চোৎ?

আচমকা গুপ্তদার মুখে খিস্তি শুনে চমকে ওঠে নিধি, চোখ কুঁচকে তাকায়, আজ ত্রিশ বছরে এই প্রথমবার। এতদিনে হয়তো লোকটা বাজারটার উপযুক্ত রোজগেরে হল।

—কত্তা, হারানটা ছেলেমানুষ, দুম করে বিয়ে করে ফেলেছে। কোথায় যাবে কচি বৌটাকে নিয়ে? এতদিন আপনার অন্ন খেয়েছে, বেইমানি করবে না। মেয়েটাকে এই হোটেলেই কাজে লাগিয়ে দেব ঠিক দেখবেন, অসুবিধে হবে না। দিব্যি আমাদের সবার সাথে মিশে যাবে। হারানটার মতো ওকেও খাওয়া-পরা দেবেন। মাইনে লাগবে না…
—আমি কি ধর্মশালা খুলেছি হারানিধি? যাকে পারবে এনে ঢোকাবে একেনে? ওরা যে বিয়ে করেছে কে সাক্ষী আছে? তোমার কথায় এই রাস্কেলটাকে কাজে রেখেছিলাম, সে কাম-কাজ যাই করুক, আমি কোনওদিন কিছু বলিনিকো, আজকে তো সীমা ছাড়িয়ে ফেলেছে। তোমার লজ্জা করছে না ওটার হয়ে দালালি করতে? না না একেনে জায়গা হবেনেকো। অত দরদ থাকলে ওই বাজারের দোতলার ঘরে রাখগে যাও গে। আমার ও ঘর সিজনের জন্য রাখা।

গুপ্তদার কথায় পুঁজময় অন্ধকার দেখে নিধি, তার চোয়াল তখন শক্ত। হারানটা রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে।

—না কত্তা ওরা ওইখানে যাইবে না। নিধির গলায় ক্রমান্বয়ী রেণুঝড় খেলে যায়।
—এত দরদ যখন নিজে বাড়ি ভাড়া করে নিয়ে রাখোগে যাও না বাপু, তোমার আদরের ধন আর তার বৌকে। আর সাথে তুমিও বিদেয় হও না কেন? আমার লজে এসব ছোটলোকি আমি বরদাস্ত করব না।
—হ কত্তা তাই হইব। রাস্তার কুত্তার তো আর ঘর হয় না। দেইখ্যা লইবেন, ওই মাইয়ারে আমি রাস্তায় ফেলাইয়া রাখুম না। আসি কত্তা ভাল থাইকবেন। বহুকাল আপনের নুন খাইসি, আপনের ব্যবসাডার বারোটা বাজামু না নিশ্চিন্তে থাইক্কেন। নইলে এই হারানিধি দাস এই বেঙ্গল লজের অনেক গুপ্ত কথাই জানে।

একটি ঠান্ডা পিস্তলসম নির্জনতা তখন ফুটে উঠতে আরম্ভ করেছে ঘরটার সিলিং জুড়ে। তারই মাঝে নিধি শুনতে পায় আশেপাশের বাড়িতে দূরদর্শনে সিনেমা হচ্ছে। ধীরগতির ইন্টারনেটের মতো শব্দগুলো ওর মগজে ঢিল ছোড়ে, আকাশ থেকে একটা দুর্বল তির এসে ওর পায়ের সামনে পড়ে। তিরটির রং নীলই থাকবে যতদিন না ওটার অন্য কোনও রং কেউ খুঁজে পায়।

বর্ষাটা এখন আরও অনেক গাঢ় হয়েছে। ভিজে হাওয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে ওর সব সুখদুঃখ। চৌকো করে মেঘ জমে বাজারটার উপর। ‘বাজারের উপর এক্ষুনি ভেঙে পড়বে— এরকম অবস্থায় দোতলার কার্নিশটার গা ঘেঁষে বেরিয়ে থাকা অশত্থর চারাটা একদিন মহীরুহ হয়ে ওঠার শপথ নেয়। তারপর হয়তো সেটা একদিন বাড়িটাকেই ফেলে দেবে। শিয়ালদহ স্টেশনের চার নম্বর গেটের কাছে ভাতের ঝুপড়ি খুলেছে নিধি, চাইলে বেঙ্গল লজের উল্টোদিকের বাজারচত্বরেও খুলতে পারত। এই বাজারে ওটাই নিধির আঁতুরঘর। কিন্তু বেইমানি নিধির ধাতে নেই। এখানে প্রত্যেকদিন আশেপাশের বিহারি দোকানদারগুলোর সঙ্গে বেঞ্চি পাতা নিয়ে ঝামেলা লাগে, নিধি ঠান্ডা মাথায় সবটুকু সামলায়। রোজ সকালে হারানের বৌটা গামছা উপুড় করে ভাতের ফ্যান গালে, সেই ফ্যান পিটুলিগোলা রাস্তাটার উপর ইচ্ছেমতো ছড়িয়ে গিয়ে অক্ষরলিপি আঁকে, ঊর্ণজালের যাযাবরী চরিত্র অববাহিকায়। বিহারি ছোকরাগুলো প্রথমদিকে কটু নজর দিয়েছিল, মেয়েটা ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। সবসময় নিধি পেছনে বটগাছের মতো দাঁড়িয়েছে। কোমরে গামছা বেঁধে হারানিধি বড় কড়াইয়ে তেল ঢালে, পিঁয়াজ-রসুন-আদা ফোড়ন দিয়ে কষতে থাকে। কষে-কষার গন্ধে পথচলতি মানুষের আতশী অষ্টপ্রহর কাটে শ্রীহীন বিরিঞ্চি নগরযাপনে। হারান উবু হয়ে বসে কয়লা ভাঙে। ওরা তিনজন এখন সার্পেন্টাইন লেনের পুরনো একটা বাড়িতে ভাড়া থাকে। বাড়িটায় সব ভদ্রলোকদের বাস, বলেকয়ে সস্তায় সিঁড়ির নিচে পুরনো একটা ঘর ভাড়ায় পেয়েছে নিধি। আর যাই হোক এখানে মেয়েটার উপর আর কোনও শকুনছায়া পড়বে না। এখান থেকে ওকে আর যোগাযোগের অজানা ক্রসিংয়ে হারিয়ে যেতে হবে না। আসাযাওয়ার পথে একান্নবর্তী দৃষ্টিতে রাস্তার ওপারের বাজারটাকে দেখে নিধি। দেখতে দেখতে ওর প্রতিটা রন্ধ্রে ঈশ্বর প্রকট হয়ে ওঠেন। বর্ষার নিষিদ্ধ বারবেলাটায় যোগনিদ্রার শীর্ষে উঠে, ওরা স্বপ্ন দেখে মহাজাগতিক দর্শনে ওদের হোটেল বেঙ্গল লজ হয়ে উঠেছে। বেঙ্গল লজে গ্যাসে রান্না হচ্ছে। তৎপুরুষ খুন্তিনাদে, বিবস্ত্র বেগুনের নাগরিকত্বকে মেনে নিয়ে রান্নাঘরদুটো মিশে গিয়ে ক্রমশ একটা উদ্বৃত্ত দেশ হয়ে উঠছে।

জামগাছের কোটর থেকে শ্রমিক মৌমাছিটা এদিক ওদিক উড়ে যায়। সামনের শীতে গাছটার নিচে লজের মিনি বেড়ালটা পোয়াতি হবে। বাজারটা কাকে ভালবাসবে আর কাকে অবহেলা ছুড়ে দেবে এই ভেবে চুপ করে থাকে।

 


*হেডার ছবিটি গল্পকারের আঁকা

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4953 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...