![bk@bom](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2018/08/bk@bom.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
চার নম্বর নিউজডেস্ক
‘ততোইহমখিলং লোকমাত্মদেহসমুদ্ভব্যইঃ
ভবিষ্যমি সুরাঃ শাকৈরাবৃষ্টইঃ প্রাণধারণকৈঃ।।
শাকম্ভরীতি বিখ্যাতিং তদা যাস্যাম্যহং ভুবি।‘
অর্থাৎ, অনন্তর বর্ষাকালে নিজদেহসম্ভূত প্রাণধারক শাকের সাহায্যে আমি সারা জগতের পুষ্টি সরবরাহ করব। তখন আমি জগতে শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হব।
দেবীর ঘোষণা — মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর এই বিখ্যাত উক্তি থেকে শুরু করে বাঙালির ব্রতকথা পেরিয়ে আদিম আজটেক সভ্যতার কৃষিভিত্তিক লোকগাথা ও ধর্মচর্চার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে কৃষি ও মাতৃসম্পর্কের এক ওতপ্রোত বাঁধন, আমাদের বেশিরভাগ চোখ ঝলসানো উৎসবের ওপরের রাংতা সরালে যে সব প্রাচীন রীতির নতশির ম্লান উপচ্ছায়া আজও উৎসুকের চোখে ধরা পড়তে বাধ্য। আজ ভারতে অনেক কিছুর মতোই চাষও যখন পুরুষের একচেটিয়া বলে ধরে নেওয়া হয়, ভাবতে সত্যি অবাক লাগে! যাক সে কথা, কিন্তু আজকে চলুন এক অন্য চাষের গল্প শুনি… যেখানে মেয়েরা এক মাটির গন্ধ ভরা নতুন দিশা এনে দিয়েছে এই প্রযুক্তিকাতর বসুন্ধরায়।
বর্ষায় উত্তর দিনাজপুরের কোনও এক সামান্য গ্রাম। ভোর হয়েছে সবে, বৃষ্টিতে কাদা হয়ে আছে রাস্তা। এমন সময় সেই রাস্তা দিয়ে হইচই করতে এগিয়ে এল একদল হাঁস, আর তাদের ঠিক পিছনে উচ্ছল তিনটি মেয়ে। টিপটিপ বৃষ্টি, এদিক ওদিক কাঁচা রাস্তার জমা জলও তাদের উৎসাহ একটুও ফিকে করতে পারেনি, তারা এখন প্রায় আরও এক কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে পৌঁছাবে ধানক্ষেতে। সেখানে এখন বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে দেড়-দু ফুট লম্বা ধানচারা। তারপর সেই সবুজ শিশুদের ঘিরে জোলো ধানী জমিতে ভেসে বেড়াবে হাঁসেদের সারি। কী ভাবছেন! চাষের গল্প না বলে প্রকৃতি বর্ণনায় আপনাদের বোর করছি কেন? ঘাবড়াবেন না, কারণ কবি বলে গেছেন, ‘ওরই মাঝে আছে নববিধানের আশ্বাস দুর্ধর্ষ!’ হাঁসগুলোকে মেয়েরা সাথে এনেছে সাঁতার কাটানো ছাড়াও একটা অন্য উদ্দেশে, হাঁসেরা চারা গাছের ক্ষতিকারক পোকামাকড়, ঝোপ ইত্যাদি খেয়ে ফেলে আর পরিবর্তে ফেলে যায় জমিতে উর্বর বিষ্ঠা। ব্যস, রাসায়নিক সার, কৃত্রিম কীটনাশক থেকে মুক্তি, খরচ থেকেও!
তবে হ্যাঁ, রোপণের পর অন্তত কুড়ি পঁচিশ দিন বাদেই এই ব্যবস্থা করা যাবে, নইলে আলগা মাটি উপড়ে হাঁস ধানগাছ খেয়ে নিতে পারে।
কী সহজ না? কিন্তু আদপে ব্যাপারটা মোটেই একদিনে হয়নি। যে যৌথ কৃষিভিত্তিক পরিবারে এই মেয়েদের জন্ম, সেখানকার সেই একঘেয়ে রাসায়নিক সার-ভিত্তিক চাষ থেকে বেড়িয়ে এই নতুন রকম সম্পূর্ণ জৈবপদ্ধতিতে চাষের চেষ্টা পরিবার থেকে গ্রাম সবারই হাসির খোরাক হয়েছিল। প্রথম বছরে এমন কিছু অভাবনীয় উৎপাদন হয়ওনি এইভাবে, ফলে আরও উপহাস। কিন্তু মেয়েরা দমে যায়নি। ৫ বিঘা জমিতে পরের বার নিজেদের সীমিত ক্ষমতায় ফলিয়েছেন প্রায় ৩৫-৪০ কুইন্টাল ধান, এমনকি অন্যান্য সব্জি। এই একই সাফল্যের ছবি উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার ব্লকের গ্রামে গ্রামে — দহল, অভিনগর, উত্তর পালইবাড়ি, বালাওল। মেয়েরা নিজেদের এই সংগঠনের একটা নামও দিয়েছেন ‘নারীশক্তি জৈব চাষি মহিলা দল’ (NJMD)।
এই মোটামুটি স্বশাসিত সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের জমি একসাথে করে এখন প্রায় পঁয়তাল্লিশ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। শুধু তাই নয়, তাদের নেত্রী মৌসুমি বসাকের বক্তব্য বিঘা প্রতি ফলন হয়েছে প্রায় ছয় কুইন্টাল, যা রাসায়নিক সারভিত্তিক উচ্চফলনশীল বিঘা প্রতি আট কুইন্টালের থেকে অল্প কম হলেও এই চাষের খরচ এতই কম যে রাসায়নিকভিত্তিক চাষের তুলনায় বিঘা প্রতি লাভ অনেক বেশি।
ফোরাম ফর ইনডিজেনাস এগ্রিকালচারাল মুভমেন্টের ছয় বছরের সদস্যা মৌসুমি ঘরের মেয়েদেরকে ধরে ধরে শিখিয়েছেন কীভাবে রাসায়নিক ছাড়াও প্রাকৃতিক কীটনাশক বানানো যায় নিম, গোবর, গোমূত্র, রসুন ইত্যাদি ব্যবহার করে। আজ নজমড-এর ৭৫ জন সদস্যাদের মধ্যে অন্তত চল্লিশ জন হাঁস দিয়ে ধান চাষ করছেন।
একজন পরিবেশ বান্ধব চাষের বিশেষজ্ঞ অর্ধেন্দুশেখর চট্টোপাধ্যায় মনে করেন যে বিশেষ করে ক্ষুদ্র চাষিদের জন্য কম দামে জৈব ধান চাষ করতে এর জুড়ি নেই। তাঁর সংস্থা ডেভেলপমেন্টাল রিসার্চ কমিউনিকেশন অ্যান্ড সার্ভিস সেন্টার বিগত তিরিশ বছর ধরে এই রকম চাষে উৎসাহ দিয়ে আসছেন। তাঁর মতে হাঁস আর ধানশিশুদের একসাথে বড় হতে দেখাটা এই প্রকল্পের এক বড় পাওনা। তার সাথেই, হাঁসেদের ঠোঁটের ধাক্কায় মাটি আলগা হয়ে বেশি অক্সিজেন ছাড়তে পারে জমিতে। ফলত, ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস এফেক্ট তৈরি করা মিথেন গ্যাস কম নির্গত হয় আর আবহাওয়া পরিবর্তনের কুপ্রভাব রদের সাথে সাথে খাদ্য নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়।
তবে যেখানে এই লড়াইয়ে মেয়েরা বড় জিতেছেন সেটা হল, বিশেষজ্ঞরা শুধু নয়, এই চাষ আজ অবাক করে দিয়েছে গ্রাম আর পরিবারের সেই মানুষগুলোকে যারা একদিন নেহাত বিদ্রূপ করেছিলেন। আজ অল্প অল্প করে একে একে তাঁরাও এগিয়ে আসছেন এই নতুন দিশায়। জৈব চাষের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার সুরাহা থেকে আবহাওয়া পরিবর্তনের চাবিকাঠি আজ মুক্ত নারীদের হাতের মুঠোয়, NJMD-র জয় আর দূর নয়।
জয় মা দুগগা!