বাবার ছেলে

মৃন্ময় প্রতিহার

 

বিশ্বাস কর, এমনটা আমি চাইনি। কেউ নিজের ভাইকে কামড়াতে পারে? আসলে ওটা আমাদের ইন্সটিংক্ট। বাংলায় কাছাকাছি করে বলতে হলে, প্রবৃত্তি। সারারাত আগান বাগান ঘুরে বেরিয়ে , পাড়া পাহারা দিয়ে বাড়ির দরজার বাইরে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম আয়েশ করে। একটু নাকও ডাকছিল মনে হয়। হেসো না, হেসো না। ভাবছ কুকুর আবার নাক ডাকে? আমার বাবাও তাই বলে লোককে। বলে, আমার মদা কুকুরকুলের বিস্ময়। কেউ শুনেছে কুকুরে নাক ডাকে! —- বাবা জানেনা, অনেকেই জানে না, কুকুরেও নাক ডাকে। কেন, কুকুরের নাক নেই, নাকি নাক ডাকায় পয়সা লাগে ? নাক ডাকায় কি মানুষেরই একচ্ছত্র অধিকার? মানুষের ওই দোষ–এত কম জানে, অথচ সবজান্তার ভাব। আমি নাক ডাকি, নিজে না শুনলেও পিয়া বলেছে। পিয়ার কথায় পরে আসছি। নিজের নাকডাকা কেই বা শুনতে পায়। তাছাড়া শুনেছি কাত্তিক নাক ডাকে, ও পাড়ার ভুলু নাক ডেকে ঘুমায়। মাধা, লালি, ভুট্টো, এরাও ডাকে। সাহেব ডগি , দাসেদের স্যাম ও তো নাক ডাকে , নিজে কানে শুনেছি। বাবা ভাবে শুধু আমিই শুধু নাক ডাকি বুঝি। আমি একা নই। নাক অনেকেই ডাকে। সারারাতজাগা ক্লান্ত শরীর, একটু আয়েশ করে শুলে নাক ডাকেই একটু। আর বাবা কি জানেনা, রাত একটু গভীর হতে না হতেই মনুষ্য পল্লীর ভেতর সব শব্দ ভেদ করে সরু, মোটা নানা ফ্রিকোয়েন্সির কিসের আওয়াজ ভেসে আসে?
ওই দেখ, কি বাজে বকি আমি। হচ্ছিল প্রবৃত্তির কথা। হ্যাঁ, শীতের হালকা মিষ্টি রোদে ঘুমটা একটু বেশি ঘন হয়ে থাকবে। দরজাটা বন্ধই ছিল। আমার ভাই, বাবার ছোটছেলে, স্কুলে যাচ্ছিল। দরজাটা খুলে আমার ল্যাজে পা দিয়েছে। আমাদের ঘুম গাঢ় হলেও সজাগ থাকি আমরা। সামান্য কিছুতেই ঘুম ভেঙে যায়। আচমকা লেজে পা পড়তেই আমি ভড়কে গিয়েই খ্যাঁক করে কামড় দিয়ে থাকব। ওটাকেই প্রবৃত্তি বলছিলাম আর কি। মুহূর্তের মধ্যেই বুঝে যাই, এই যা! এ তো আমার ভাই!! ছেড়ে দিই সঙ্গে সঙ্গে । কিন্তু হলে কি হবে! ভাই আমার ভয় পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ওর দোষ নেই, বাচ্চা তো এক্কেবারে। কিন্তু বিশ্বাস কর, দাঁতের দাগ বসে গেলেও কাটেনি কিন্তু। ভাইয়ের কান্নার শব্দে আমার মা, ঠাকুমা ছুটে এল। আমি এগিয়ে এসে ওদের ব্যাপারটা বোঝাতে গেলাম, ঠাকুমা, ওগো মা গো, দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিস ব্রজ! দেখে যা তোর আদরের কুকুর ছেলেটাকে কামড়ে দিলে! এবার কি হবে!

বুড়ির চেঁচামেচির চোটে ঘাবড়ে গিয়ে একটু দূরে সরে গেলুম। ভাই তখনো চেঁচাচ্ছে। ও একটু বেশিই আদুরে। মানুষের ছেলেরা অমনই হয়। ওরা আমাদের মতো নয়। শুনেছি নাকি সবচেয়ে বুদ্ধিমান জাত, আর দেখ– মানুষের বাচ্চারই সাবালক হতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে। ওরা যখন হাঁটতে শেখে আমাদের তখন বিয়ের বয়স হয়ে যায়। অবশ্য আমরা বাঁচিও ঢের কম। যাইহোক, ব্রজ , অর্থাৎ আমার বাবা বাড়িতেই ছিল। ছুটে এল । আমার বাবাকে আমি ভয় পাই খুব। রাগী লোক। দু চারবার আমায় খুব পিটিয়েছে। আজ ভাইকে কামড়ে ফেলেছি, বাবা নিশ্চয়ই খুব রেগে থাকবে। ভয় পেয়ে আরেকটু সরে গেছি। বাবা এসে ভাইয়ের ক্ষতটা দেখে আমার দিকে তাকালো। আমি ভয়ে, লজ্জায় মাথাটা নামিয়ে কেটে পড়াই ভাল মনে করলাম। বাবা কড়া গলায় ডাকল ,—- মদা। আমি সে গলা চিনি। খুব বুঝলাম, আজ বাবা আমার ছাল তুলে দেবে। একবার মনে হল, যা থাকে কপালে, বাবার কাছে চলে আসি, আবার সেই মারের কথা মনে হল। লজ্জাও পাচ্ছিল খুব। না জানি ছোট্ট ভাইটার কত লেগেছে। আমি পিছন ফিরে উল্টো দিকে হাঁটা দিলাম। পিছন থেকে বাবার কঠিন গলা ভেসে এল, —- মদা। আমি ঘুরে দেখার সাহস পেলাম না। শুনতে পেলাম, ঠাকুমার তীক্ষ্ণ গলা, রাস্তার জিনিস রাস্তাতেই ভাল ব্রজ। ওদের মাথায় তুলতে নেই রে….বেইমান জাত…. ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঠাকুমার কথা গুলো আর কানে ঢুকছিল না কিছু। আমরা, মানে কুকুররা বেইমান জাত!! কি জানি । কি বেইমানি আমি করেছি জানি না। ঠাকুমা আসলে আমাদের সহ্য করতে পারেনা, আমি জানি। বাবা যখন দুদিনের আমায় রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল, তখনও মনে হয় ঠাকুমা বাবাকে খুব বলেছিল। বাবা কথা শোনে নি। আমার জন্য দরজার পাশে সুন্দর একটা কাঠের ঘর বানিয়ে দিয়েছিল। এখনো মনে পড়ে, শীতের সকালে যখন ঠান্ডায় কাঁপতাম, বাবা আমায় জড়িয়ে ধরে গা গরম করে দিত। আমি আরামে চোখ বুজে থাকতাম। ঠাকুমা গজগজ করতো। বাবা পাত্তা দিত না। আমার প্রথম প্রথম বুড়িকে সহ্য হতনা। বাবা খাবার থালায় খাবার ফেলে রাখত, বলত, আর ক্ষিদে নেই, আমি বুঝতাম , আমায় খাওয়াবে বলে। বুড়ি তাতেও রাগ দেখাত। আমিও বুড়ির পিছনে লাগতাম। নতুন দাঁত দিয়ে বুড়ির কাপড় ছিঁড়ে দিয়েছি। বুড়ি গাল দিতে দিতে লাঠি হাতে তাড়া করত, লেজ তুলে দৌড়ে নাগালের বাইরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াতাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বুড়ি শাসাত, আজ ব্রজ ঘরে ফিরুক। তোকে দূর না করে আমি জল খাবনা।
আমার মজা লাগত খুব। বুড়ির সাথে এদিক ওদিক ঘুরতে যেতাম। আমি বেশ বুঝি, ওই চিৎকার , চেঁচামেচি আসলে বাইরের। ঠাকুমাও আমায় ভালবাসে। ধীরে ধীরে আমিও বাড়ির একজন হয়ে গেলাম। বাবা আমায় লোকেদের কাছে পরিচয় দিত ছেলে হিসাবে। নাম দিয়েছিল , মদন, ডাকনাম মদা। আদরও যেমন খেয়েছি, মারও খেয়েছি বাবার কাছে। বাড়াবাড়ি করে ফেললে। এই যেমন ধরো, স্নান করা নিয়ে। জলে আমার খুব এলার্জি। বাবাকে কে বোঝায় যে মানুষের মতো রোজরোজ স্নান করার আমাদের দরকারই পড়েনা। আমাদের গায় অত গন্ধ নেই। আর মানুষের সাবান মানুষেরই ভাল, আমাদের ওসব সহ্য হয়, বলতো? সে কে বোঝাবে? মার ধোর করেও জলে আমায় না নামাতে পেরে বাবা আমায় জলে ছুঁড়েই দিত। কি জ্বালা! কেঁউ কেঁউ করে উঠে গা ঝাড়িয়ে নিয়ে একটু শুকনো হয়েছি কি, আবার নিয়ে ফেলে দিত। শীতকালে ওসব সহ্য হয়, বল দেখি!
তবে বাবা আমায় ভালবাসতো খুব। একবার আমার আমারই মতো দুটো কুকুর, বেশ মাতব্বর গোছের, আমায় ডাকল। দেখি বাবা ঠাকুমার চেয়ে এদের সাথে আমার শরীরের মিল বেশি। এদের আমার মতো লেজ আছে যেটা বাবার নেই। আমায় দেখে খুব বকাবকি করল, কুকুর হয়ে মানুষের ঘরে আছি! স্বাধীনতা বন্ধক দিয়েছি! ছ্যা। তারা আমায় তাদের সঙ্গে পালিয়ে যেতে বলল, ভয় পেয়ে আমি বাড়ি পালিয়ে আসতে যাব, রাগ করে তারা আমায় শাসন করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মরেই যেতাম বাবা না থাকলে। একটা লাঠি নিয়ে কোত্থেকে বাবা কুকুর দুটোকে লাঠিপেটা করে মেরে ভাগাল। তারপর আমায় বুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে আমার ক্ষত স্থানে মলম লাগিয়ে দিল যত্ন করে। সেই সাথে হুমকি, আর যদি দেখি, কুকুরের সাথে বেরিয়েছিস, ঠ্যাং খোঁড়া করে ফেলে রাখব।—না বাবা, আমার দরকার নেই। সেই প্রথম কামড় খাওয়া আমার।
আরেকবার ডাক্তার এসে আমায় ইঞ্জেকশন দিল। ভ্যাকসিন না কি যেন বলে। সেই নিয়ে আমি তো প্রায় মরতে বসেছিলাম। সাতদিন কিচ্ছু দাঁতে কাটতে পারিনি। বাবা কত চেষ্টা করল, অন্য ডাক্তার এনেছিল। কোনোমতে বেঁচে যাই। বাবা খুব ঝগড়া করল সেই আগের ডাক্তারের সঙ্গে। বুঝতাম, বাবা আমায় খুব ভালোবাসে।
এরপর পিয়া এল আমার জীবনে। আগেই ওর কথা বললাম না! পিয়া আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যেত, এখানটায় দাঁড়িয়ে যেত একটু। আমায় দেখত। প্রথম প্রথম পাত্তা দিতাম না তেমন একটা। খেতে না পাওয়া হাড় বের করা শরীর। তবুও নতুন যৌবনের একটা আবেদন ছিল ওর মধ্যে। একটা নেশায় পড়ে গেলাম। একদিন ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম লুকিয়ে। লুকিয়ে , কারণ জানি বাবা জানলে বিপদ। কুকুরের সাথে মেশামিশি বাবা পছন্দ করবে না। আমায় আগেই বলে দিয়েছিল। পিয়ার সঙ্গে বেরিয়ে জগৎটাকে নতুন ভাবে চিনলাম। দেখলাম, আমার প্রজাতির জীবন আমার মতো এত সহজ সুন্দর নয়। এখানে অহরহ লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। খাবারের জন্য লড়াই, এলাকার জন্য লড়াই, নারীর জন্য লড়াই। সবসময় কামড়া-কামড়ি চলছেই। অবাক হয়ে পিয়াকে বলি, এ জীবন কেমন জীবন! এত মারপিট, এত অভাব নিয়ে বেঁচে থাকা যায়! বাবাকে বলে নাহয় পিয়ার একটা হিল্লে করে দেব। পিয়া রাজি হলনা কিছুতেই। ও বলল, মদন, তোমার খাবারের অভাব নেই, আরামের অভাব নেই, কিন্তু স্বাধীনতাও যে নেই। তুমি তো পোষা গোলাম। আমরা দেখ, খালি পেটেও কেমন স্বাধীন। মারপিট করেও কেমন তৃপ্তির খাওয়া খাই। ওর কথা বিশ্বাস হয়নি। আমি আমার বাড়িতে গোলাম! আমার স্বাধীনতা নেই! আমার ভালোবাসা নেই? পিয়া ওসব বুঝবে না। তাও পিয়ার মধ্যে কিছু একটা ছিল, আমায় ওর দিকে আকর্ষণ করত । আমায় এত বাজে কথা বললেও রোজ সকালে ও কিন্তু আমার বাড়ির সামনে লেজ নাড়তে নাড়তে হাজির হবেই। একই কি প্রেম বলে? হবে হয়ত।

পিয়ার সাথে আমার অভিসার বাবার কানে কেউ তুলল। আমার গলায় উঠল বকলস। বাঁধা পড়ে আমার হৃদয়াবেগ বেড়ে উঠল। আর না হবেই বা কেন বল! তখন দুই বছর বয়স পার করেছি আমি। আমার নয়, বয়সের দোষ। তাছাড়া এবার যেন আমার মনে হতে লাগল, সত্যি, আমি পরাধীন। আমি বাঁধা থাকতাম। পিয়া বাইরে থেকে আমায় দেখত। তারপর চলে যেত। একদিন কিভাবে চেনটার বাঁধন খুলে গেল। আমি চেন গলায় নিয়েই পিয়ার পিছনে ছুটলাম। যেন মুক্তির আনন্দ। পিয়ার চোখ মুখেও খুশির ঝলক। হটাৎ, পিছন থেকে বাবার গলা পেয়ে বুকটা ধড়াস করে উঠল। কঠিন গলায় বাবা হাঁকছে, মদা , ফিরে আয়, ফিরে আয় বলছি। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। এ ডাক অস্বীকার করি এ সাধ্য আমার নেই। পিয়া বলল, কি ব্যাপার, দাঁড়িয়ে পড়লে! চল। আমি ইতস্তত করছি দেখে পিয়া বলল, কাম অন মদ। জীবনে চল। সামনে জীবন। পিছনে শেকল। সামনে আমায় পাবে। আমাদের পাবে। পিছনে গোলামী। আমি সামনে এগিয়ে যাওয়াই স্থির করলাম। বাবা খানিকটা ছুটে এসেছিল। ভাঙা গলায় মদা, মদা ডাক আমার কানে বাজে আজও। আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম। জীবনের দিকে। তবে বাবার ওই ডাক বড় কষ্ট দিয়েছিল তখন। অনেকটা দূরে গিয়ে পিছনে ফিরে চেয়ে তাকিয়ে ছিলাম, বাবা আমার চলে যাবার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। এতদূর থেকেও বুঝেছিলাম , বাবার চোখে জল। আমাদের চোখের দৃষ্টি প্রবল কিনা।

তা , জীবনকে দেখলাম আমার চোখে। আমাদের কুকুরের চোখে। বুঝলাম, বাবা কেন আমার কথা বুঝলনা। পিয়া আমার সঙ্গে কিছুদিন ছিল। তারপর আরেকটা জাঁদরেল মোটাসোটা কুকুরের সঙ্গে চলে গেল। আমায় বলে গেল, দুঃখ করোনা মদ। এটাই জীবন । মানুষের মতো না ভেবে কুকুরের মতো ভাব। এখানে স্থায়ী বলে কিছু নেই। তুমিও অনেক পিয়া পাবে, তবে দখল নিতে হবে। এখানে ছিনিয়ে নিতে হয়। আমরা বীর ভোগ্যা। দুর্বলের এখানে অধিকার নেই। মানুষের সাথে বড় হয়ে ওঠা বলে মানবিক একটা মন তৈরী হয়ে উঠেছিল। পিয়ার ওই কথায় দুঃখ পেয়েছিলাম। তবে সত্যও চিনিয়ে গেল পিয়া। আমিও দখল করতে শিখলাম। মানুষের ঘরে অপর্যাপ্ত খাওয়া দাওয়ার কারনে তাগদের অভাব আমার ছিলনা। আমিও লড়াই করে জিততে শিখলাম। খাদ্য , এলাকা, নারী। একাধিক সঙ্গিনী জুটল। আমাদের সমাজে এটাই চল । প্রাকৃতিরও বোধহয় ওটাই বিধান। আমাদের সমাজে আইন নেই। প্রাধান্য প্রবৃত্তির। আর সেটা বিধাতা নির্দেশিত। ওটাই বিজ্ঞান। যে যোগ্য , টিকবে সে। ভোগ করবে সে। সন্তান জন্ম দেবে সে। দুর্বল জিনের এখানে ঠাঁই নেই। তবে পিয়ার জন্য মন খারাপ হত মাঝে মাঝে। ও-ই আমার ফার্স্ট লাভ। আমার স্বরূপ চিনিয়েছিল সে-ই।

মাস ছয়েক পর বাড়ির কথা মনে পড়ল। গেলাম। দেখি ঘরে নতুন এক মানুষ এসেছে। বুঝলাম, আমার বাবা মার ছেলে। ও মানুষ, কারণ লেজ নেই। খুব ভালো লাগল। আমার ভাই হবে তাহলে। আমার ভাই, আমার বাবার ছেলে। ভেবেছিলাম বাবা বুঝি রাগ করবে আমায় দেখে। তা হল না। বরং কান মূলে আদরই করল। তাও বুঝলাম, সেই জায়গা আমার নেই। এ বাড়ি আর আমার বাড়ি নেই যেন। সেই ঘরটাও নেই। আমি দুটো জীবনের সাথেই মানিয়ে নিলাম। বাড়িতেও থাকতাম, কুকুরের সমাজেও। আপত্তি ওঠেনি আমার মানুষ সান্নিধ্যে। আর তুলবেই বা কে? আমার চেয়ে শক্তিশালী কে ছিল? দুজায়গাতেই সময় দিতে লাগলাম। ভায়ের সাথেও খেলতাম। আবার প্রেয়সীদের সাথে বাদাবন, ভাগাড় ঘুরেও আসতাম। ঠাকুমা গালাগালি করত, তবে খেতেও দিত। নোংরা গায় থাকলে তাড়াও দিত। বুঝতাম, ভাইয়ের শরীর খারাপ হতে পারে ভেবে ওরা উদ্বিগ্ন। ও তো মানুষ। কত কিছু সুবিধা নিয়ে বাঁচে। প্রকৃতিও তাই প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে । আমি পুকুরে গা ডুবিয়ে পরিষ্কার হয়ে আসতাম। না, ভায়ের জন্য আমি আমার জলের এলার্জি কাটিয়ে উঠেছিলাম।
কষ্ট লাগত বাবার আচরণে। বাবা আমায় আর বকত না। তবে আর ভালোওবাসত না তেমন মনে হয়। খুব ইচ্ছা করত, আবার আমায় টেনে নিয়ে কোলে তুলে আমার ঘাড়ের লোমে শুড়শুড়ি দেবে, চোখ বুজিয়ে আমি ঘড়ঘড় করে আওয়াজ করে আরামের জানান দেব। দুঃখ পেলেও কিছু করার নেই। বাবার আশ্রয় আমিই ছেড়ে গেছি। বাবাকে কষ্ট দিয়েছি। তবে বাবারও আমায় একটু বোঝা উচিত ছিল বলেই আমি মনে করি। সবাই ভাইকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বুঝি আমি। নিজের ছেলে। আমি তো সত্যিকার ছেলে নই, কুড়িয়ে আনা রাস্তার কুকুর। তবে অভিমান বেশি করতাম না। লজ্জা, অভিমান, দুঃখ এই অনুভূতিগুলো আমাদের কম। বুঝতাম, নিজের সন্তান কি জিনিস। তোমাদের আশীর্বাদে আমিও তখন গোটা দশেক বাচ্চার বাবা। একবার আমার বাবাকে আমার বাচ্চাগুলো দেখিয়ে তার বন্ধুদের কাছে বলতে শুনেছি, আমি দাদু হয়ে গেলুম, দাদু।
বেশ চলছিল সময়। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক আবার বাড়ছিল ধীরে ধীরে। ভাই বড় হল। হাঁটতে শিখল। আমার সাথে খেলত। আমার গায়ে উঠে বসত, আমায় মারত। কি যে ভাল লাগত! ভায়ের প্রিয় খেলা ছিল ঘোড়া ঘোড়া খেলা। আমার পিঠের উপর চড়ে কান দুটি পাকিয়ে বলতো, তল তল ঘোয়া তল। মজা পেতাম। ও তো ছোট, বুঝতোই না আমি ঘোড়া নই, কুকুর। মানুষেরা বড্ড দেরি করে বড় হয়।
ভাই স্কুলে যাবে, আমার কি আনন্দ। জামা, জুতো ব্যাগ নিয়ে দারুন লাগছিল ওকে। স্কুলের রিকশা গাড়ি এসে নিয়ে গেল, আমি অনেক দেখেছি এমন। পিছু পিছু গেলাম স্কুল অব্দি। বসে রইলাম সারাক্ষণ। ছোট ছেলে, যদি মন খারাপ করে বায়না করে!

এবার তো বুঝলে, ভাইকে কামড়ে দেওয়াটা নেহাতই দুর্ঘটনা। আমাদের প্রবৃত্তির ঝোঁকে হয়ে যাওয়া। খুব লজ্জা হচ্ছিল, সাথে দুশ্চিন্তা। নাজানি ওর কতটা লেগে থাকবে। দূর থেকে লক্ষ্য করেছি বাবা ভাইকে নিয়ে শ্যামল ডাক্তারের কাছে গেল। ভায়ের নরম শরীরে ছুঁচ ফুটিয়ে ডাক্তার ইঞ্জেকশন দিল। ভাই আবার কেঁদে উঠল। এসব আমার জন্য। আমারই জন্য। মনে এত অনুশোচনা হল কি বলি! নাঃ, বাড়ি আমি আর যাব না। মুখ দেখাতে পারবনা।

সত্যি আবার বাড়ি ছাড়লাম। আশপাশ দিয়ে ঘুরে যেতাম , ঢুকিনি আর। ভাইকে দেখতাম স্কুলে যায় , আসে। মা বা ঠাকুমা সন্ধ্যার পর রাস্তা দিয়ে ফিরলে তফাৎ রেখে পিছু নিতাম। রাস্তায় অন্য কুকুর বা অন্য বিপদের কবলে না পড়ে। দুজনেই অনেকবার ডাকাডাকি করেছে, কিন্তু বাড়ির সামনে থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে এসেছি। যাইনি। কুকুর হলেও আমিও তো ও বাড়ির সন্তান। আমারও মর্যাদা বোধ আছে। কম হলেও আছে। একবার বাবাও রাস্তায় ধরে কান পাকড়ে টানাটানি করে বাড়ি যেতে বলল। সত্যি বলি, অভিমানে চোখ দিয়ে জল এল। উল্টোমুখে ফিরে দৌড়ে পালালাম। বাবা দাঁড়িয়ে রইল রাস্তায়।

ওসময়টা তেই বদ সঙ্গে পড়ে একটা বদ নেশা জোটালাম। ভাগাড়ের গরুর মাংস টানা। কালু, শিবা এরা যেত নিয়মিতই। আমি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতাম। বাবা খুব রাগ করত ভাগাড়ের হাড় গোড় টানাটানি করলে। একবার ছোট একটা হাড় কুড়িয়ে পেয়ে মুখে করে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম, আমার পিঠে চ্যালা কাঠ ভেঙেছিল বাবা। পচা মাংস আমার ভালোও লাগত না তাছাড়া। আর মাংস খেতে গিয়ে ওই উন্মত্ততা , মারপিট এসব আমি ঘৃণা করতাম। কালু , শিবার পাল্লায় পড়েই একবার ভাগাড়ে চলেই গেলাম। আমি ভাগাড়ে এসেছি, ওদের খুব আনন্দ। বন্ধুকে বদ নেশা ধরাতে পারার আনন্দ আর কি। আমায় ছিঁড়ে ছিঁড়ে সরেস মাংস দিল। আহা, বেশ তো! এমন স্বাদ তো জানতাম না। কেমন একটা নেশা চড়ে গেল। নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম মড়া গরুটার শরীরের ওপর।

তারপর থেকে নিয়মিতই ভাগাড়ে যাই। ভাগাড়ে যাওয়া কুকুরদের মানুষেরা দেখতে পারেনা। আমাকেও বাবা একদিন ভাগাড়খোর, এবার তুই মরবি, বলে মারতে এসেছিল , চোখে রাগ। পালিয়ে বেঁচেছিলাম। তবে আমার আর কিছু করার ছিলনা। একটা নেশায় পড়ে গিয়েছিলাম। পচা মাংসের স্বাদই আলাদা। সে তোমরা বুঝবেনা। তোমাদের সেই অনুভূতিই নেই। তাছাড়া, সহজ খাদ্য। আমারও বয়স হয়েছে। আর লড়াই করে কেড়ে খাব, মুশকিল হয়ে গেছে। তাগড়া জোয়ানদের সাথে সবসময় পেরে উঠিনা আজকাল। আমার এক ছেলেই তো এখন গাঁয়ের সরদার। যৌবনের আমার মতোই তাগড়া। আমাকেই একবার পুকুরের কাদা পাঁকে চুবিয়ে ছেড়েছিল। আমি মানে মানে ওর জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওদের সময়। ওদের রাজত্ব। তোমায় জায়গা ছেড়ে দিতেই হবে। আমাদের সমাজে বাবা, মা, ভাই বোন এ সম্পর্কগুলোর বাঁধন অত তীব্র নয়। যার যা যোগ্যতা , তার বেশি কেউ পায়না। আমার তাই পেট ভরে না রোজ। তাও তো লোকের বাড়ি গেলে আমায় খেতে দিত লোকে। মদাকে অনেক মানুষই ভালো বাসত। তাও খিদে মেটে না ভাগাড় যাই। খানিক পেটের টানে, খানিক স্বভাবদোষে।
একদিন দাসেদের পেঁয়াজের বীজতলা জমিতে দেখি গরুর পা পড়ে আছে। কি ব্যাপার! সকাল বেলা অযাচিত ভাবে নেশার জিনিস পেয়ে যেতে তৃপ্তি করে খেলাম, চুষলাম বেশ করে। আহ। মনে হয় আমাদেরই কেউ ভাগাড় থেকে টেনে আনার সময় তাড়া খেয়ে এই জমিতে ফেলে রেখে পালিয়েছে। নইলে দাসবুড়ো পাকা শয়তান। ওর বীজতলা নষ্ট করি বলে কুকুরদের ওপর লোকটা নির্মম ছিল। আমাদের মারতে কত কায়দাই না ফাঁদত।

এই যাহ, ফাঁদের কথায় খেয়াল হল। এটাও ফাঁদ নয়ত! কুকুর মারার জন্য! মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেল। খিদের চোটে বুঝতেই পারিনি মাংসতে কি একটা গন্ধ আছে। সত্যি, খিদে এমনই জিনিস, যা কুকুরের ঘ্রাণশক্তিও কেড়ে নিতে পারে। পেটের ভেতরটাও গুলিয়ে উঠল এবার। দৌড়ে গিয়ে পুকুরধারে গিয়ে অনেকটা জল খেলাম। বমি করে উগড়ে দেবার চেষ্টা করলাম। বমি হল, তবে সে নিজে নিজেই। পেটের ভিতরটা যেন কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কি জ্বালা। বাবাগো! তুমি কোথায়! বুঝে গেছি আজ আমার নিস্তার নেই। মনে পড়ে গেল ছমাস আগেই দাসবুড়োর জমিতে মরা ছাগলের বিষ মাখানো মাংস খেয়ে কালো, শিবা দুজনেই চলে গেছে। আজ আমিও যাবো। বুঝতেই পারিনি। আর বুঝবই বা কি করে বলতে পারো! আমরা কুকুর। বাঁচার জন্য লড়াই করি, খাবার জন্য খেয়োখেয়ি করি। পরিকল্পনা করে তো কাউকে হত্যা করিনা। ফাঁদ পেতে কাউকে মারি না। বিষ দিইনা কাউকে। ওসব তোমরা পারো। তোমরা , ভগবানের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তোমাদের বুদ্ধি আছে। তোমরাই পারো ষড়যন্ত্র করতে। আমরা পশু , বুদ্ধিটাই তো নেই। তোমাদের ফাঁদ এড়াব সাধ্য কি !

প্রবল পেটের যন্ত্রণা, ভেদবমন শুরু হল। আজ বড় বাড়ির কথা মনে পড়তে লাগল। আমার বাবা, আমার ঠাকুমা, আমার মা, আমার ভাই—- সবার মুখ চোখে ভেসে এল। একবার ওদের খুব দেখতে ইচ্ছে হল। কেমন আছে আমার ভাই! আমার বাবা! দেখিনি অনেকদিন। শরীরটা টানতে টানতে কোনোমতে বাড়ির দরজায় নিয়ে এলাম। তখন আমার অবস্থা খারাপ। জিভ বেরিয়ে এসেছে ওটুকু পরিশ্রমেই। আমায় দেখে ঠাকুমা হাউমাউ করে উঠল। হায়, সর্বনাশ— হতভাগা কোথা থেকে বিষ খেয়ে এসেছে গা। জিভটা নীল হয়ে ঝুলে গেছে! ছুটে এল মা, ভাই। বাবা কই, বাবা? অফিস গেছে মনে হয়। ঠাকুমা জল নিয়ে এসে আমার মুখে মাথায় ঢালল। আঃ, কি আরাম! কি শান্তি। কিন্তু শরীরে বড় কষ্ট হচ্ছিল। জলটা চেষ্টা করেও খেতে পারলাম না। জিভটায় সাড় নেই। মুখ থেকে জল পড়ে গেল। মা কেঁদে উঠল ডুকরে। ভাই আমার গায়ে হাত বোলাতে লাগল। তাকিয়ে দেখি সবার চোখে জল, আমার চোখেও জল। স্বাধীনতার মূল্য চোকাতে হল আমার এভাবেই।
শেষ শক্তি জড়ো করে একবার উঠে দাঁড়ালাম। আমায় যেতে হবে। এবাড়িতে মরে আমি নোংরা করব না। এ আমার বড় প্রিয় জায়গা। বাইরে আমাদেরই খামার ঘর আছে। ওখানটায় চলে যাব। ওটাও আমাদেরই। গরু থাকে, চাষবাসের জিনিস থাকে। আমার চলে আসা দাঁড়িয়ে দেখল ঠাকুমা, মা , ভাই। ঘুরে একবার দেখলাম , ঠাকুমা আঁচলে চোখ মুছছে।
দু চারটে খড় কোনোমতে টেনে নিয়ে বিছানা করলাম। আমার অন্তিম শয্যা। এবার ঘুম পাচ্ছে আমার । খুব ঘুম পাচ্ছে। শুয়ে পড়লাম। বাবার ফিরতে ফিরতে রাত। ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নিই।

Be the first to comment

আপনার মতামত...